ভুট্টা একটি গুরুত্বপূর্ণ অর্থকরী ফসল। ভুট্টার উৎপাদন ক্ষমতা ধান ও গমের তুলনায় অনেক গুণ বেশী। তাই তণ্ডুল জাতীয় দানা শস্যগুলির মধ্যে ভুট্টাকে দানা শস্যের রানী' বলা হয়। খাদ্যগুণের বিচারেও ভুট্টার স্থান উচ্চমানের। ভুট্টা মনুষ্য খাদ্য হিসাবে ২৫ শতাংশ, প্রানী খাদ্য হিসাবে ১২ শতাংশ, পোলট্রা (হাঁস ও মুরগী) খাদ্য হিসাবে ৪৯ শতাংশ, শিল্পে (বিশেষত স্টার্চ উৎপাদনে) ১২ শতাংশ এবং পানীয় ও বীজ হিসাবে ১ শতাংশ ব্যবহার হয়ে থাকে। ধান ও গমের তুলনায় ভুট্টার পুষ্টিমূল্য অপেক্ষাকৃত বেশী। ভুট্টায় কার্বোহাইড্রেট, ফ্যাট, প্রোটিন ও কিছু প্রয়োজনীয় ভিটামিন পাওয়া যায়। অপুষ্টিজনিত রোগীদের পক্ষে সর্বোত্তম আহার। দরিদ্র শ্রেণীর শিশুদের জন্য উৎকৃষ্ট প্রোটিন, জন্মহারের উন্নয়ন ও শিশুমৃত্যু রোধেও সহয়তা করে। ইহা রক্তাল্পতা, কোষ্ঠকাঠিন্য, লিভার সিরোসিস ইত্যাদি রোগ নিরাময় করে। স্তন্যদানকারী মায়েদের উৎকৃষ্ট আহার। গরু, মহিষ ও শুকরের জন্য চমৎকার খাবার। শুকরের দেহের ওজন ৩-৬ গুণ বৃদ্ধি পায়। মাছের কুড়ো ইত্যাদি প্রোটিনের চেয়ে দামে সস্তা। বর্তমান বিশ্বের বিভিন্ন দেশে তথা ভারতে ক্রমশই চাহিদা বাড়ছে বিভিন্ন মুখরোচক খাদ্য ,পশুখাদ্য এবং মৎস খাদ্যে।
- গমধান ও ভুট্টার খাদ্যগুণ তুলামূলক বিচার দেখা যায় -
- কার্বোহাইড্রেট ৭৮.২%, ফ্যাট ০.৫%, প্রোটিন ৬.৮% থাকে।
- গম কার্বোহাইড্রেট ৭১.২% , ফ্যাট ১.৫% , প্রোটিন ১১.৮% থাকে।
- ভুট্টা কার্বোহাইড্রেট ৬৬.২%, ফ্যাট ৩.৬%, প্রোটিন ১১.২% থাকে।
শস্য বৈচিত্র করণে রবিশস্য হিসাবে ভুট্টা আদর্শ ফসল। বিশ্বে উষ্ণায়ণের ফলে পরিবেশের পরিবর্ত্তন, বৃষ্টির উপর প্রভাবফেলেছে। প্রকৃতির খাম খেয়ালিপনায় যেমন পৃথিবীর তাপমাত্রা বাড়ছে অন্যদিকে শীতের সময়কাল কমছে। ফলে চাষীরা যেমন গম চাষের আগ্রহ হারাচ্ছেন তেমনি আবহাওয়া পরিবর্তনে, অনিয়মিত বৃষ্টিপাত ও বৃষ্টিপাতের পরিমাণ কমে কারণে বোরো ধানে চাষের জল পাওয়া কঠিন হয়ে পড়ছে। অন্যদিকে ১০ সেন্টিগ্রেড ৩৫ সেন্টিগ্রেড তাপমাত্রায় ভুট্টা ভালোভাবে চাষ ও আশানুরূপ ফলন পাওয়া যায়। তাই গম ও বোরো ধানের বিকল্প হিসাবে ভুট্টা চাষের এলাকা ক্রমশ বাড়ছে। বিকল্প জ্বালানী ইথানল প্রস্তুতিতে ভুট্টার ব্যবহার বাড়ছে। চাষ করতে গিয়ে চাষীদের বিশেষ কিছু সমস্যার সম্মখিন হতে হচ্ছে। বিভিন্ন রোগ ও পোকার আক্রমণের কারণে ফসল নষ্ট হচ্ছে। তবে সময় মতো সঠিক পদ্ধতি অবলম্বন করে ব্যবস্থা গ্রহণ করলে ফসল সুরক্ষায় সাফল্য পাবে।
ক) ভুট্টার রোগ ব্যবস্থাপনা -
১. মেডিস লিফ ব্লাইট (MLB) -
রোগের লক্ষণ-
এটি সাধারণত পাতা তে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ৪-৬ মিলি.মি চকচকে স্পট পড়তে দেখা যায় প্রথমে এবং ধীরে ধীরে লম্বাকারে বাড়তে থাকে এবং বাদামি রং ধারণ করে। পরবর্তীতে পাতার শিরা থেকে কাণ্ডে ছড়িয়ে পরে এবং গাছ ছোট থাকলে কিছু দিন পরে মারা যায়।
করণীয় -
এই রোগ দেখা দিলে ক্ষেত থেকে সংক্রমিত ফসলের অবশিষ্টাংশ ধ্বংস করে ফেলতে হবে এবং এই রোগ এড়িয়ে চলার জন্যে প্রতিরোধী/সহনশীল হাইব্রিড বীজ ব্যবহার করতে হবে।
রোগাক্রান্ত হলে ম্যানকোজেবের ফলিয়ার স্প্রে @ ২.৫ গ্রাম/লিটার জলে বীজ বপনের প্রায় ১৫ দিন পর ও 30-35 দিন পর নিয়মানুবর্তিতা হিসাবে ব্যবহার করলে কার্যকর হয় এবং এর পর প্রতি বারেই 10 দিনের ব্যবধানে বা উপসর্গ দেখা দেওয়ার সাথে সাথে আরও দুটি স্প্রে করতে হবে।
এছাড়াও ফলিয়ার স্প্রে Azoxystrobin ১৮.২% + Difenconazole ১১.৪% w/w SC ১মি:লি/ লিটার জলে গুলি উপসর্গ দেখা দেওয়ার সাথে সাথে ব্যবহার করলে কার্যকর ফল পাওয়া যায়।
২. টারসিকাম লিফ ব্লাইট (TLB)
রোগের লক্ষণ -
ভুট্টায় এই রোগের লক্ষণ হল প্রথমে ক্ষত হয়ে সরু, ট্যান রেখার মতো প্রদর্শিত হতে পারে যা পাতার শিরাগুলির সমান্তরালে চলে উপবৃত্তাকার নেক্রোটিক ধূসর-সবুজ ক্ষত যা পাতায় এক থেকে সাত ইঞ্চি লম্বা হয় । সম্পূর্ণরূপে বিকশিত ক্ষতগুলি সাধারণত একটি কালি যুক্ত চেহারা ধারণ করে । রোগের অগ্রগতির সাথে সাথে ক্ষতগুলি একসাথে বৃদ্ধি পায় এবং একটি সতেজ পাতার থেকে বড়ো অংশ জুড়ে মৃত পাতার অংশ বৃদ্ধি পায়।
প্রতিকারে করণীয় -
টারসিকাম লিফ ব্লাইট রোগের তীব্রতা কমানোর জন্যে ফসল চক্র হিসেবে শিম জাতীয় ফসলের চাষ করলে সংক্রামিত রোগের অবশিষ্টাংশগুলি ভেঙে যাওয়ার সময় দেওয়া হয় এবং পরবর্তী সময়ে ভুট্টা চাষ করলে অতিরিক্ত শীতকালে ছত্রাক এর আক্রমণ থেকে ফসলকে রাখা করা যায় ।
এই রোগ এর লক্ষণ দেখা দিলে ফসলের অবশিষ্ট্যাংশ ধ্বংস করে ফেলা উচিত এবং প্রতিরোধী/সহনশীল হাইব্রিড বীজ ব্যবহার করা উচিত।
ভুট্টা বীজ বপনের আগে Azospririllum (ACD ১৫ বা ACD ২০ Stran) @ ২৫ গ্রাম এবং ট্রাইকোডার্মা @ ৬ গ্রাম প্রতি কেজি বীজ বা থিরাম ৭৫ WP @ ২ গ্রাম বা Capatn ৫০ WP @ ২ গ্রাম প্রতি কেজি বীজ দিয়ে বীজ শোধন করতে হয়।
এই রোগের লক্ষণ দেখা দেওয়ার সাথে সাথে ২.৫ গ্রাম ম্যানকোজেব ৭৫ ডব্লিউপি বা ১ মি.লি হেক্সাকোনাজল ৫ ই.সি বা ১ মি.লি কম্বিপ্রোডাক্ট ছত্রাকনাশক Azoxystrobin ১৮.২% + Difenconazole ১১.৪% প্রতি লিটার জলে মিশিয়ে স্প্রে করতে হবে। ১৫ দিন পর আবার এর একই পুনরাবৃত্তি করুন যা কার্ভুলারিয়া পাতার দাগ নিয়ন্ত্রণে সহায়তা করে।
৩. কার্ভুলারিয়া পাতার দাগ
রোগের লক্ষণ -
এই রোগ দেখা দিলে ভুট্টার পাতাগুলি বাদামী মার্জিন সহ ছোট, সাদা রঙের ক্ষত যা একটি হলুদাভ আবরণ দ্বারা বেষ্টিত হয়ে থাকে । এই ক্ষতগুলি পাতা জুড়ে বা ঘন ঘন দলে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকতে পারে এবংপরবর্তীতে ফসল ক্ষেতের একটি বৃহত্তর অংশ জুড়ে ছড়িয়ে পড়তে পারে। এই ক্ষত প্রায়ই পাতার মাঝামাঝি থেকে উপরের ভুট্টার পাতার শেষ পর্যন্ত পরিলক্ষিত হয়, তবে এই রোগ গাছের যে কোনো বৃদ্ধির পর্যায়ে দেখা দিতে পারে। ভালো করে বুঝার চেষ্টা করলে দেখা যায় এই পাতার দাগের লক্ষণগুলি চোখের দাগের মতো অনেকটা দেখতে হয়।
রোগের প্রতিকার -
প্রতিরোধী/সহনশীল হাইব্রিড ব্যবহার বীজ ব্যবহার করতে হবে এবং ২০ গ্রাম ট্রাইকোডার্মা চক ফর্মুলেশন + ম্যানকোজেব ৬৩% বা থিরাম ৪০ FS @ ৬ গ্রাম/কেজি বীজ দিয়ে বীজ শোধন করে রোপন করতে হবে।
ভুট্টা ফসলকে বাতাস সাথে চলাফেরা করে এমন রোগ থেকে ফসলকে নিরাপদ রাখতে মাঠের আশেপাশের আগাছা তুলে ফেলতে হবে।
রোগ দেখা দিলে কার্বেন্ডাজিম ১২%+ ম্যানকোজেব ৬২% বা জিনেব ৭৫% @ ২ গ্রাম/লিটার দ্রবণ ব্যবহার করে ৩৫ এবং ৫৫ ডিএএস এ করলে ভালো ফলাফল পাওয়া যায়।
৪. ব্যান্ডেড লিফ এবং শিথ ব্লাইট
রোগের লক্ষণ -
এই রোগ সাধারণত - ছোট গাছে কম দেখা দেয় , মূলত ৪০-৪৫ দিন বয়সী গাছে দেখা যায়। সাধারণত প্রথমে মাটির উপর দ্বিতীয় পাতাতে দেখা যায় বাদামি ধূসর রং এর কালো গোলাকার দাগ । ক্রমশ শিরায় ছড়িয়ে পরে এবং ধীরে ধীরে উপরে উঠতে থাকে এবং পাতা গুলি শুকিয়ে যায়। অনেক ক্ষেত্রে গাছ গুলি মারা যায়।
রোগের প্রতিকার -
রোগ প্রতিরোধী/সহনশীল হাইব্রিড ব্যবহার বীজ ব্যবহার করতে হবে। গোড়ার পাতা গুলি ছেঁটে ফেলে দিতে হবে।
গাছ আক্রান্ত হলে Azoxystrobin ১৮.২% + Difenconazole ১১.৪% w/w SC (Amistar Top ৩২৫ SC) 1ml/L জল ৫০ DAS এ বা উপসর্গ দেখা দেওয়ার পরপরই স্প্রে করতে হবে। যদি প্রয়োজন হয় তবে ১৫ দিনের ব্যবধানে আবার স্প্রে করতে হবে একই ভাবে।
৫. কাঠকয়লা পচা
রোগের লক্ষণ -
এটি সাধারণত মাটি বাহিত রোগের কারণে হয়। ফল আসার পূর্বে বা ফল আসার পরে গাছ হঠাৎ শুকিয়ে যায়। গাছের গোড়া থেকে শুরু হয় এবং ধীরে ধীরে গাছ শুকিয়ে যায়। গাছের কাণ্ডের ভেতর কালো রঙের অবশেষে দেখা যায়।
এই রোগ এড়িয়ে চলার জন্যে শস্য আবর্তন গ্রহণ করা উচিত। মাটিতে ট্রাইকোডার্মা ভিরিডি চাষের পূর্বে বিঘা প্রতি ২ কেজি ব্যবহার করা প্রয়োজন হয়। ফুল ফোটার সময় অতিরিক্ত জল ব্যবস্থাপনা এড়িয়ে চলতে হবে। রোগ প্রতিরোধী/সহনশীল হাইব্রিড ব্যবহার করতে হয়।
বপনের আগে প্রতি কেজি বীজে 25 গ্রাম পিএসবি (সিউডোমোনাস স্ট্রিয়াটা এইচ-21) এবং 6 গ্রাম ট্রাইকোডার্মা হারজিয়ানাম বা 5 মিলি থিরাম ফ্লো 40 এফএস দিয়ে বীজ শোধন করে রোপন করলে এই রোগের সম্ভাবনা থাকে না।
6. Fusarium ডাঁটা পচা
রোগের লক্ষণ -
এই রোগে উদ্ভিদ আক্রান্ত হলে উদ্ভিদ শুকিয়ে যায়। উদ্ভিদ এর পাতা গুলি হালকা থেকে নিস্তেজ সবুজে পরিবর্তিত হয়ে ডালপালা খড়ের রঙে পরিণত হয় এবং সংক্রমিত বৃন্তের ভিতরে লালচে দাগ দেখা যায়।
রোগের প্রতিকার -
বীজ রোপনের পূর্বে মাঠ জীবাণুনাশক দিয়ে স্যানিটেশন করতে হবে। সুষম মাত্রায় সার প্রয়োগ করতে হবে (টাসিয়ামের মাত্রা বাড়িয়ে নাইট্রোজেনের ডোজ কমিয়ে দিতে হবে এবং রোগ প্রতিরোধী/সহনশীল হাইব্রিড প্রজাতি রোপন করতে হবে।
৭. ব্যাকটেরিয়া ডাঁটা পচা
রোগের লক্ষণ -
এই রোগ দেখা দিলে দেখা যাবে মাটির উপরে কাছাকাছি ডালপালা গুলি জলে ভিজে বাদামী রঙের হয়ে যায় এবং মোচড় না দিয়ে সহজেই ভাঙ্গা যায়। পচনশীল টিস্যু আস্তরণ গুলি একটি পচা গন্ধ নির্গত করে। যে জায়গায় এটা আক্রান্ত হয় গাছের ডাঁটার গোড়ায় গাঢ় রঙ এবং জল ভিজিয়ে থাকে এবং ডগা ভাঙার পরেই চারা গাছ মরে যায়।
রোগের প্রতিকার -
রোগাক্রান্ত উদ্ভিদ উঠিয়ে ধ্বংস করে দিতে হবে এবং ফসল উঠে যাওয়ার পর মাঠে অবশিষ্ট্যাংশ ধ্বংস করে দিতে হবে। জল নিকাশির জন্যে পর্যাপ্ত ড্রেনেজ ব্যবস্থা বজায় রাখতে হবে এবং রোগ প্রতিরোধী/সহনশীল হাইব্রিড বীজ ব্যবহার করতে হবে।
আক্রান্ত হলে ব্লিচিং পাউডার Ca (ClO) ২ কে ১.৫ গ্রাম/১৫ লিটার জলে দিয়ে ভিজিয়ে স্প্রে করতে হবে।
৮. সাধারণ মরিচা
রোগের লক্ষণ -
এই সাধারণত গাছের পাতার উপর ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র বাদামি রঙের স্পট পড়তে দেখা যায় অনেকটা লোহার উপর মরিচা পড়ার মত। ধীরে ধীরে সেই জায়গা গুলি কালো হয়ে শুকিয়ে গিয়ে পাতার অনেকাংশ নষ্ট করে কাণ্ডে রোগ শুরু হয় এবং অবশেষে গাছ মারা যায়।
রোগের প্রতিকার -
এই রোগে উদ্ভিদ আক্রান্ত হলে ছত্রাকনাশক ডাইথেন এম-৪৫ প্রয়োগে @ ২.৫- ৪ গ্রাম/লিটার জলে গুলিয়ে পাতায় প্রথম মরিচা রং পুঁজ দেখা দিলে স্প্রে করতে হবে। রোগ গুরুতর আকার ধারণ করলে ১৫ দিনে অন্তর অন্তর তিনটি স্প্রে করতে হয়।
৯. রাজস্থান ডাউনি মিলডিউ -
রোগের লক্ষণ - এই রোগে আক্রান্ত হলে সাধারণত পাতায় ক্লোরোটিক রেখার বৃদ্ধি দেখা দেখা যায়। পাতার নিচের দিকে সাদা ডাউনী বৃদ্ধি দেখা যায়। পাতার বৃদ্ধি কমে যায় এবং ফুল গুলি পুরুষ ফুল আকার নেয়। গাছ গেলাম জাতীয় হয়ে যায় সঠিক চেহারায় উদ্ভিদের বৃদ্ধি হতে দেখা যায় না।
রোগের প্রতিকার -
এই রোগে আক্রান্ত হলে সংক্রামিত উদ্ভিদ পুড়িয়ে ধ্বংস করে ফেলতে হয়। আক্রান্ত প্রতিরোধের জন্যে Apron ৩৫SD @ ৪ গ্রাম/কেজি বীজ দিয়ে বীজ শোধন করে রোপন করতে হবে এবং বীজ বপনের 20-২৫ দিন পরে মেটালাক্সিল + ম্যানকোজেব (০.১%) দিয়ে পাতায় স্প্রে করতে হবে।
১০. সর্গাম ডাউনি মিলডিউ
রোগের লক্ষণ -
এই রোগ দেখা দিলে পাতার নিচের অর্ধেক অংশে ক্লোরোসিস লক্ষণীয়। পাতাগুলি সরু হতে থাকে এবং সাদা সাদা সরু দাগ দেখা দেয়। ধীরে ধীরে সাদার অংশ বাড়তে থাকে। উপরের পাতা গুলি বাকতে শুরু করে এবং মাথায় ছোট ছোট পাতা বের হতে শুরু করে।
রোগের প্রতিকার -
সঠিক সময়ে রোগ প্রতিরোধী/সহনশীল হাইব্রিড বীজ মেটালাক্সিল + ম্যানকোজেব (WS) দিয়ে ৩.০ গ্রাম/কেজি হারে মিশিয়ে রোপণ করতে হবে।
বীজ রোপনের ২০ দিন পর পাতায় Azoxystrobin ১৮.২% + Difenconazole ১১.৪% w/w SC (০.১%) স্প্রে করতে হবে।
১১. নন-পোকামাকড়- ভুট্টার সিস্ট নেমাটোড
রোগের লক্ষণ -
ভুট্টার সিস্ট নিমাটোডগুলি ছোট কৃমি যা উদ্ভিদের শিকড়ে বাস করে । এটি সাধারণত উদ্ভিদ এর ছোট অবস্থাতেই আক্রন্ত করে। মূল গুলিতে ধীরে আক্রমণের মাত্রা বেড়ে গেলে গাছ গুলি কালো হয়ে শুকিয়ে মারা যায়।
রোগের প্রতিকার -
রোগ প্রতিরোধের জন্যে শস্য আবর্তন করে চাষ যেমন : সয়াবিন, তুলা এবং শাকসবজির মতো অ-শস্যজাতীয় ফসলের সাথে ক্রপ রোটেশন প্রয়োগ করে চাষ করতে হবে।
ভুট্টার সিস্ট নিমাটোড ব্যবস্থাপনার জন্য তিলের সাথে ভুট্টার আন্তঃফসল (২:২ সারি 30 সেমি দূরে ) রোপন করে চাষ করলে ঝুঁকি কম থাকে। রোগ প্রতিরোধী/সহনশীল হাইব্রিড বীজ অবশ্যই ব্যবহার করতে হবে
খ) কীটপতঙ্গ ব্যবস্থাপনা :-
ভারতে ভুট্টার চারটি প্রধান কীটপতঙ্গ রয়েছে। এগুলি হল গোলাপী স্টেম বোরার, দাগযুক্ত স্টেম বোরার , শুট ফ্লাই এবং ফল আর্মিওয়ার্ম । ইন্টিগ্রেটেড পেস্ট ম্যানেজমেন্ট (আইপিএম) রাসায়নিক, জৈবিক, নতুন শস্য পদ্ধতি, ফসল চাষ পরিবর্তন, প্রতিরোধী জাত ব্যবহার করে কীটপতঙ্গ নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসা যায়।
১. গোলাপী স্টেম বোরর
নির্ণয়ের বৈশিষ্ট্য
রবি মৌসুমে বিশেষ করে বেশি শীতের সময়ে গোলাপী কাণ্ডের পোকা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কীটপতঙ্গ যা ২৫.৭ থেকে ৭৮.৯% এর মধ্যে ভুট্টা ফলনের ক্ষতি করে। এর ডিমগুলি ক্রিমি সাদা, পুঁতির মতো পাতার খাপের ভিতরে থাকে। এই কীটপতঙ্গের লার্ভাগুলি বেগুনি আভা সহ হালকা গোলাপী বর্ণের হয়। এই লার্ভা গুলির সময়কাল 22-36 দিনের মধ্যে পরিবর্তিত হয়ে থাকে। মোট জীবনচক্র 40-53 দিনের মধ্যে পরিবর্তিত হয়।
ক্ষয়ক্ষতির ধরন
গোলাপী বোরর লার্ভা দলে দলে পাতার খাপের ভিতরে লুকিয়ে থাকে হ্যাচিং এর সময় এবং পাতার খাপের এপিডার্মাল স্তরে খাবার খায় বিশেষত প্রথম তিনটি পাতার খাপে। লার্ভা গুলি অঙ্কুরে প্রবেশ করে ফলে বৃদ্ধির স্থান শুকিয়ে যায় এবং চারা গুলি লার্ভা কান্ডের ভিতরে বৃত্তাকার আকৃতির টানেল তৈরি করে এবং পৃষ্ঠে গর্ত করে। লার্ভা গুলি যে সুড়ঙ্গ বা ছিদ্র তৈরী করে সেগুলি মলমূত্রে ভরা।
ব্যবস্থাপনা
সংক্রমণ সময়ে 10% অতিক্রম করলে, ক্লোরেন্ট্রানিলিপ্রোল ১৮.৫ SC @১৫০ml/ha স্প্রেকরে নিয়ন্ত্রণ করা যায়।
২. দাগযুক্ত স্টেম বোরার
নির্ণয়ের বৈশিষ্ট্য
স্পটেড স্টেম বোর ভারতের বিভিন্ন কৃষি-জলবায়ু অঞ্চলে ২৬ -৮০% এর মধ্যে ফলনের ক্ষতি করে।এটি খরিফ মৌসুমের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কীটপতঙ্গ। ডিম সমতল, ডিম্বাকৃতি, হলুদাভ এবং ওভারল্যাপিং ক্লাস্টারে পাড়া হয়। লার্ভা ক্রিমি গোলাপী থেকে হলুদাভ বাদামী বর্ণের হয় যার পিছনে লালচে বাদামী মাথার সাথে 4 সারি বিন্দুযুক্ত ডোরা থাকে। পুরুষ পতঙ্গে, পিছনের ডানা ফ্যাকাশে খড়ের রঙের হয় এবং স্ত্রীদের ক্ষেত্রে সাদা হয়। জীবনচক্র প্রায় 5-6 সপ্তাহের মধ্যে সম্পন্ন হয়।
ক্ষতির ধরন
এগুলি ডিম সাধারণত পাতার নিচের পৃষ্ঠে পারে। ৩-৪ দিনের মধ্যে ডিম ফুটে এবং সদ্য ফুটা লার্ভা পাতার ভিতর হামাগুড়ি দিয়ে দলবদ্ধভাবে খাবার খায় । পাতা গুলি তে পিনের ছিদ্র দেখা যায় এবং কাগজের নেয় পিছন দেখা যায় পাতার।
ব্যবস্থাপনা
ভুট্টায় এই সংক্রমণ ১০% অতিক্রম করলে ক্লোরেন্ট্রানিলিপ্রোল ১৮.৫ SC @১৫০ml/ha স্প্রে করে নিয়ন্ত্রণ করা যায়।
৩. ফল আর্মিওয়ার্ম, স্পোডোপ্টেরা ফ্রুগিপারডা (জেই স্মিথ)
নির্ণয় বৈশিষ্ট্য :-
ফল আর্মিওয়ার্ম (FAW) হল একটি আক্রমণাত্মক কীটপতঙ্গ যা ভুট্টার বৃদ্ধির সব পর্যায়ে মারাত্মক ক্ষতি করে। এটি ভারতে প্রথম মে, ২০১৮ এ রিপোর্ট করা হয়েছিল এবং পশ্চিমবঙ্গে নদীয়া জেলাতে প্রথম দেখা গিয়ে ছিল । স্ত্রী মথরা পাতার উপরের দিকে বা নীচে ডিম পাড়ে এবং ঢেকে রাখে। লার্ভাগুলি মসৃণ-চামড়া যুক্ত এবং তিনটি ক্রিমি হলুদ পৃষ্ঠীয় এবং পার্শ্বীয় রেখা সহ হালকা কষা বা সবুজ থেকে নিস্তেজ ধূসর দেহের রঙে পরিবর্তিত হয়। লার্ভাতে লালচে বাদামী মাথা থাকে এবং চোখের মাঝে সাদা, উল্টানো Y-আকৃতির সিউন থাকে। পিউপা লালচে বাদামী বর্ণের। ৭-৯ দিন পর, পূর্ণবয়স্করা পিউপা থেকে বের হয়। প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষ পতঙ্গের অগ্রভাগে শ্যামলা রঙের দাগ এবং ডানার এপিকাল মার্জিনে একটি সাদা ছোপ থাকে যখন স্ত্রী পতঙ্গগুলি অভিন্ন ধূসর বাদামী থেকে ধূসর। মোট জীবনচক্র প্রায় ৩০-৩৫ দিনের মধ্যে সম্পূর্ণ হয় যা জলবায়ু পরিস্থিতি অনুযায়ী পরিবর্তিত হয়। প্রাপ্তবয়স্কদের দীর্ঘায়ু ৪-৭ দিনের মধ্যে পরিবর্তিত হয়। প্রাপ্তবয়স্ক মথ ডিম্বাশয়ের আগে ৫০০ কিলোমিটার পর্যন্ত উড়তে পারে।
ক্ষতির ধরণ
FAW ভুট্টা ফসলের চারা গজানোর ছোট পাতার থেকে বড়ো পর্যন্ত আক্রমণ করে থাকে। FAW এর অল্প বয়স্ক লার্ভা পাতার উপরের তার চারপাশে খাওয়ায় যার ফলে কাগজের দাগ হয়। ক্ষতির ফলে পাতায় ছিদ্র দেখা দেয়। এগুলি পাতা থেকে ফল ও ফুল পর্যন্ত আক্রমণ করে। ক্ষতির ফলে পাতার ব্যাপক ক্ষয় হয় এবং ফলের ক্ষতি হয়। ভুট্টার কলার ভেতর ছিদ্র করে এবং দানাগুলো খেয়ে ফেলতে পারে।
ব্যবস্থাপনা -
এই পোকা নিয়ন্ত্রণ বিভিন্ন করা যায়। নিয়মিত মাঠ পর্যবেক্ষণ করে জৈবিক , রাসায়নিক ও ফাঁদ এর ব্যবহার করে আক্রমণ নিয়ন্ত্রণ করা যায়। আগাম সতর্কতা হিসাবে কার্বোফিউরন ৩ জি ১৩.২ কেজি প্রতি একর জমিতে চাষের শুরুতে দিলে এই পোকার আক্রমণ থেকে আগাম ব্যবস্থা গ্রহণ করা যায়।
আক্রমণের শিমা চরম পর্যায়ে গেলে রাসায়নিক প্রতিষেধক হিসাবে লার্ভাগুলি যখন ছোট পর্যায়ে থাকবে তখন ইমামেকটিন বেনজয়েট ৫% এস জি ৪ গ্রাম প্রতি লিটার জলের সাথে মিশিয়ে স্প্রে করতে হয় এবং লার্ভাগুলি বড়ো হলে থায়ামেথোক্সাম ১২.৬% এর সাথে ল্যাম্বডা সায়হেলথ্রিন ৯.৫% ০.৫ মিলি এক লিটার জলের সাথে মিশিয়ে স্প্রে করলে নিয়ন্ত্রণে আনা যায়।
অথবা নোভালিউরন ৫.২৫% এর সাথে ইমামেকটিন বেনজয়েট ৯% এস সি ১.৭৫ মিলি এক লিটার জলের সাথে মিশিয়ে স্প্রে করতে হবে।
৪. শুট ফ্লাই
নির্ণয় করার উপায় -
ফেব্রুয়ারির তৃতীয় সপ্তাহ থেকে মার্চের প্রথম সপ্তাহে ভুট্টা বপন করলে শুট ফ্লাই গাছের ব্যাপক ক্ষতি করে ।এটি ৬০% পর্যন্ত উদ্ভিদের ক্ষতি এবং প্রায় ২১% শস্যের ফলনের ক্ষতির কারণ বলে জানা গেছে। এর ডিম ছোট ধানের শীষের মতো লম্বাটে, দুধের সাদা রঙের দুটি ডানার মতো অনুমানযুক্ত। এর জীবনচক্র প্রায় 3 সপ্তাহে সম্পন্ন হয়। পূর্ণ বয়স্ক মাগোট হলুদ রঙের হয়। কান্ডের ভিতরে পিউপেশন হয়। পিউপা গাঢ় বাদামী, পিপা আকৃতির। প্রাপ্তবয়স্ক 3-4 দিন বেঁচে থাকে।
ক্ষতির ধরণ
ভুট্টাকে 2 দিন বয়সী চারা থেকে তিন সপ্তাহের মধ্যে ডিমের ডিম্বাণু দ্বারা বেসাল পাতা, অঙ্কুর এবং গাছের গোড়ার খুব কাছের মাটিতে ডিম্বাণু স্থাপন করে আক্রমন করে। খাওয়ার সময় ম্যাগটস অঙ্কুরে প্রবেশ করে, ধীরে ধীরে অংকুরের বৃদ্ধির বিন্দুকে মেরে ফেলে। মূল অঙ্কুর শুকিয়ে যায় যা অঙ্কুরোদগমের দুই সপ্তাহের মধ্যে তৈরি হয়।
ব্যবস্থাপনা কৌশল
ফেব্রুয়ারির প্রথম সপ্তাহের মধ্যে বপন শেষ করতে হবে।
বপনের পূর্বে ইমিডাক্লোপ্রিড ৬০০ এফএস @ ৬ মিলি/কেজি বীজ বা থায়ামেথক্সাম ৩০ এফএস @ ৮.০ মিলি প্রতি কেজি বীজ দিয়ে বীজ শোধন করলে সুবিধা পাওয়া যায়।