রাইজোবিয়াম বলতে বোঝায় বিভিন্ন জাতের মিথোজীবি জীবাণু বা ব্যাক্টেরিয়া যারা মূলত শুঁটি জাতীয় উদ্ভিদের শিকড়ে গুটি বানিয়ে বাস করে - এরা স্বাধীনভাবে দীর্ঘ সময় বাঁচতে ও বংশ বিস্তার করতে পারে না। যে গাছের শিকড়ে গুটি বানায় সেই গাছের উপর খাদ্যের ও জলের জন্য নির্ভর করে বেঁচে থাকে ও বংশ বৃদ্ধি করে। বিনিময়ে বাতাসের নাইট্রোজেনকে সরাসরি গ্রহণ করে ও নিজের দেহের মধ্যে নানা বিপাকীয় কার্যের মাধ্যমে আশ্রয়দাতা গাছের জন্য নাইট্রোজেন ঘটিত খাদ্য প্রস্তুত করে এবং আশ্রয়দাতা গাছকে সরবরাহ করে। এই জন্য এই জীবাণু বা অণুজীবকে রাইজোবিয়াম জীবাণু সার হিসাবে ডাকা হয়। আমরা যেমন গাছের বৃদ্ধির ও অধিক উৎপাদনের জন্য বাইরে থেকে নানা রকম জৈব, রাসায়নিক সার প্রয়োগ করি তেমনি বিশেষ করে শুঁটি জাতীয় (ডাল জাতীয়) ফসলে এই জীবাণু নাইট্রোজেন ঘটিত সারের (ইউরিয়া, অ্যামোনিয়াম সালফেট ইত্যাদি) বিকল্প হিসাবে ব্যবহার করে উৎপাদন বাড়ানো যায়। এই সার ব্যবহার সহজ, সস্তা এবং পরিবেশ ও মাটির কোনও ক্ষতি করে না। বিভিন্ন পরীক্ষা ফলাফল থেকে দেখা গেছে, প্রায় সবকরমের ডাল জাতীয় ফসল তার দরকারি নাইট্রোজেন এই অণুজীবের সাহায্যে সংগ্রহ করতে পারে। শুধু তাই নয় ডালের পরের ফসলও প্রয়োজনীয় নাইট্রোজেনের অনেকটাই ওই জমি থেকে পেতে পারে৷ দেখা গেছে ফসল কাটাবার পর জমিতে পড়ে থাকা নাইট্রোজেনের পরিমাণ প্রতি বিঘায় প্রায় ৬ কেজি। তাই ডালশস্য চাষে ভাল উৎপাদন পেতে রাইজোবিয়ামের ব্যবহার অবশ্যই বাড়াতে হবে৷ রাইজোবিয়াম জীবাণু অল্প খরচে অনেক বেশি সারের জোগান দিতে পারে৷
১.রাইজোবিয়াম জীবাণুর জাত :-
বিভিন্ন শুঁটি জাতীয় ফসলের জন্য নির্দিষ্ট জাতের রাইজোবিয়াম জীবাণু ব্যবহার করা হয় কারণ এরা নির্দিষ্ট আশ্রয়কারীর উপর নির্ভরশীল। যেমন:
ফসল
ক. মটরশুঁটি, মুসুরি, খেসারি ডাল এর জন্যে রাইজোবিয়াম লেগুমিনেসিরাম প্রজাতি।
খ. সয়াবিন এর জন্যে রাইজোবিয়াম জ্যাপোনিকাম প্রজাতি।
গ . বরবটি, অড়হর, মুগ, ছোলা, মাসকলাই বা বিউলি, বাকলা এর জন্যে রাইজোবিয়াম এসপি প্রজাতি।
রাইজোবিয়াম জীবাণুসার অন্যান্য জীবাণুসারের মতোই বীজের সাথে মিশিয়ে বা বীজের গায়ে মাখিয়ে ব্যবহার করা হয়। প্রয়োজনে (ফসল জমিতে থাকা অবস্থায়) কিছু পরিমাণ গোবর বা কম্পোস্ট সারের সাথে মিশিয়ে অথবা জলে গুলে ফসলের গোড়ায়ও দেওয়া যায়। এক্ষেত্রে ফসলের বৃদ্ধিকালের প্রথম দিকে অবশ্যই দিতে হবে। ফুল আসার কাছাকাছি বা পরে এই সার প্রয়োগে ফল পাওয়া যাবে না।
২.রাইজোবিয়াম জীবাণুসার ব্যবহার করার পদ্ধতি :-
সারটি বীজের গায়ে মাখানোর জন্য ঘন দ্রবণ তৈরি করে নিতে হয়। দ্রবণ তৈরির পদ্ধতি নীচে দেওয়া হল :-
- এই দ্রবণের দ্বারা রাইজোবিয়াম বীজের গায়ে লেগে থাকে এবং এটা রাইজোবিয়ামকে প্রথম দিকে খাদ্য দিয়ে বেঁচে থাকতে সাহায্য করে।
- দ্রবণটি তৈরি করার জন্য ভাতের মাড়ে পরিমাণ মতো জল মেশাতে হবে যাতে আঁঠালো ভাব আসে। তারপর এই দ্রবণটি ১৫ মিনিট ফোটাতে হবে। তবে মনে রাখতে হবে, দ্রবণের পরিমাণ নির্ভর করবে কতটা বীজে মাখাতে হবে তার উপর।
- এই ফোটানো দ্রবণটি ঠান্ডা হলে তাতে, বিঘে প্রতি বীজের জন্য ৩০০ গ্রাম রাইজোবিয়াম মিশিয়ে দিন। ব্যবহারের আগে প্যাকেটে লেখা ব্যবহারের সময়সীমা দেখে নিন। পুরনো জীবাণু ব্যবহার করা উচিত নয়। তারপর এই রাইজোবিয়াম মিশ্রিত দ্রবণ এক বিঘেতে যতটা বীজ লাগবে তার সাথে ভালো করে মাখাতে হবে। দেখতে হবে যাতে সমস্ত বীজের গায়ে দ্রবণটি লেগে যায় এবং ঝুরঝুরে হয়।
- রাইজোবিয়াম মাখানো বীজগুলিকে ছায়াযুক্ত জায়গাতে শুকাতে হবে। এরপর শুকনো বীজগুলিকে বপন করা যাবে।
- যদিও বীজে রাইজোবিয়াম মাখিয়ে ব্যবহার করা ভালো, তবে চারা গাছের গোড়ায় জলে গুলেও ব্যবহার করা যায়। এই পদ্ধতিতে পরিমাণ মতো পরিষ্কার জলে, বিঘে প্রতি ৩০০ গ্রাম রাইজোবিয়াম মিশিয়ে নিতে হবে। নিড়েন দেওয়ার সময় গাছের গোড়ায় দেওয়া হয়। ফসল ভেদে বিঘে প্রতি ৮০-১০০ লিটার জলের দরকার হয়। আবার ঝুরঝুরে ভালো গোবর বা কম্পোস্ট সারের সাথে মিশিয়ে ফসলের গোড়ায় দেওয়া যায়।(তেত্রিশ শতকে এক বিঘে হিসেবে ব্যবহার মাত্রা বলা হয়েছে )
৩. সাবধানতা অবলম্বন :-
- রাইজোবিয়াম প্যাকেট ঠান্ডা ও অন্ধকার জায়গায় রাখা দরকার, যতদিন না ব্যবহার হচ্ছে। এটা পরিবহনের সময়ও প্রয়োজন।
- রাইজোবিয়াম জীবাণুসার একটি সীমিত ও নির্দিষ্ট দিনের মধ্যে ব্যবহার করা দরকার। সেই কারণে প্যাকেটের গায়ে লেখা ব্যবহারের সময়সীমা (বা এক্সপায়ারি তারিখ) দেখে ব্যবহার করবেন।
- রাইজোবিয়াম দ্রবণ বীজের গায়ে মাখিয়ে শুকনো করার সঙ্গে সঙ্গে ব্যবহার করা দরকার। এই বীজে কখনও রোদ লাগানো উচিত নয়।
- বীজ বপনের পর তা ভালো করে মাটি চাপা দেওয়া দরকার।
- রাইজোবিয়াম দ্রবণ মাখানো বীজ রাসায়নিক সার কীটনাশক ইত্যাদির সংস্পর্শে নষ্ট হয়ে যায়।
- অম্ল মাটিতে রাইজোবিয়াম দ্রবণ মাখানো বীজের সঙ্গে চুন অথবা রক ফসফেট ব্যবহার করা দরকার। চাষ জমিতে পর্যাপ্ত পরিমানে জৈব কার্বন থাকা আবশ্যক , তাই নিয়মিত জৈব সার ব্যবহার করে জমিতে কার্বন শক্তি বাড়িয়ে তুলতে হবে।
৪. ভালো জাতের রাইজোবিয়াম নির্দিষ্ট কিছু ডাল শস্যের জন্যে :-
ক. ছোলা : ‘এফ ৭৫’, ‘এইচ৪৫’, ‘আই সি ৭৬ত
খ. মুসুর: 'এল ১-৭৭', 'এল ২১-৮৩’
গ. মটর : 'পি১০-৭৬
ঘ. খেসারি: ‘কে-৫’
ঙ. অড়হর : ‘আই এইচ পি১৯৫’, ‘আই সি ৩১০০', সি সি ১', 'এ২', 'এ১৯'
চ. মুগ : ‘জি এম বি এস ১’, ‘এম ১০’, ‘কে এম ১’, ‘এম ও ৫’
ছ. বিউলি (কালো কলাই) : ‘বি এম বি এস পি- ৪৭’, ‘ডি ইউ ২’, ‘বি ডি এন এফ’, ‘কে ইউ ১’, ‘উবাদ ১০-ব',
জ. বরবটি : ‘টি এ এল ১৬৯’, ‘জি এম বি এস ১’, ‘ডি সি ২৮’, ‘ডি সি ৬’, ‘কাউপি -১০৯’
ঝ. কুলতী কলাই : “ভি ডি বি জি’, ‘এম কে পি’, মাঠবিন : ‘এম টি ২৬-৩’
তথ্য সূত্র -
ড: বিবেকানন্দ সান্যাল ( প্রাক্তন কৃষি আধিকারিক )