জৈব ধান চাষ ও রোগ পোকা নিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি

Didibhai Agrofarm
0
জৈব ধান চাষ ও রোগ পোকা নিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি


বাঙালির প্রধান খাদ্য ভাত কিন্তু সেই প্রধান খাদ্য আজ বিষাক্ত হয়ে যাচ্ছে আমাদেরই কারণে আজ আমরা বিষমুক্ত খাদ্য উৎপাদন করতে পাচ্ছিনা কোথাও একটা মনে হচ্ছে আমরা আমাদের পরিবারকে এই প্রকৃতিকে ,মাটি যে আমাদের মা হয়ে অন্য জুগিয়ে যাচ্ছে ,যেন শত ব্যথা যন্ত্রনা সহ্য করেও আমাদের সকলের খাওয়ার জুগিয়ে যাচ্ছে তাদেরকে আমরা ভালোবাসতে পারিনি।  কিন্ত সবার একটি সহ্য ক্ষমতা আছে ধীরে ধীরে মাটি তার উৎপাদন শক্তিকে হারিয়ে ফেলছে ,মাটি বিষাক্ত হয়ে যাচ্ছে মাটিতে বসবাসরত কেঁচো ,জীবাণু তাদের শক্তি হারিয়ে ফেলছে ফলে মাটি অনুর্বর হয়ে যাচ্ছে। যারা গাছে খাদ্য পৌঁছে দেওয়ার জন্যে রান্না করে সেই উপকারী জীবাণু গুলি শেষ হয়ে যাচ্ছে। আমরা রোগাগ্রস্থ হয়ে পড়ছি বিষাক্ত খাদ্য গ্রহণ করে একদিকে রাসায়নিক ক্রয় করতে হিমশিম খাচ্ছি অপরদিকে ডাক্তার আর ঔষধের পিছনে ছুটতে গিয়ে মাঝে কিছুই থাকছে না আমাদের হাতে। ধীরে ধীরে শরীর ক্যান্সারের মতো মারাত্মক রোগে আক্রান্ত হচ্ছে যার জ্বলন্ত প্রমান দেখা যায় পাঞ্জাবে প্রচুর পরিমানে রাসায়নিক ব্যবহার করে  পাঞ্জবে সবুজ বিপ্লব ঘটেছিলো আজ সেখানে ঘরে ঘরে ক্যান্সার রোগে আক্রান্ত , বয়স্ক শিশু কেউ বাদ যাচ্ছেনা। ক্যান্সার আক্রান্তের সংখ্যা রোজ এতো টা বেড়েছে যে ভাটিন্ডা থেকে বিকানের ক্যান্সার ট্রেন শুধু ক্যান্সার রোগীর জন্যে চলে। তারা উৎপাদনের তাগিদে প্রকৃতি ,মাটি কে ভালোবাসতে পারেনি তাই আজ প্রকৃতিও তাদের তাই ফিরিয়ে দিচ্ছে তাই এখন তারা বাধ্য হচ্ছে জমির উপরের এক ফুট মাটি কেটে সরিয়ে ফেলে চাষ করতে  । বাংলাতেও একই অবস্থা শুরু হয়েছে ডাক্তারদের নিজেদের কথোপকথনে একটু কান দিলে সোনা যায় যে যত রোগ হচ্ছে তার বেশিরভাগ রোগের কারণ রাসায়নিক সার কীটনাশক প্রয়োগে উৎপাদিত বিষাক্ত খাদ্য গ্রহণ।

 জমি তার শক্তি হারিয়ে ফেলার জন্যে শক্তি বৃদ্ধির জন্যে আরো রাসায়নিক ঢেলে যাচ্ছি। এর থেকে পরিত্রান কোথায় বা বিকল্প পথ কি যদি জানার চেষ্টা করা হয় তবে একমাত্র পথ জৈব কৃষি যা ব্যবহার করে আমরা বিষমুক্ত খাদ্য আমাদের পরিবারের মুখে তুলে দিতে পারি রোগ মুক্ত শরীরে সুস্থসবল শরীরে বাঁচতে পারি। মাটি তার শক্তি বৃদ্ধি করে পুনরায় কম সার প্রয়োগে এবং রাসায়নিক মুক্ত খাদ্য আমাদের জন্যে উপহার পেতে পারি। 

জৈব চাষ নিয়ে সরকারি বেসরকারি ভাবে প্রচার ও প্রশিক্ষণ হচ্ছে সারা দেশে। বিভিন্ন রাজ্য জৈব চাষের উপর বেশি জোর দিয়েছে যাদের মধ্যে কিছু রাজ্য জৈব রাজ্য ও অনেক রাজ্যের কিছু গ্রাম জৈব গ্রাম হিসাবে ঘোষিত হয়েছে। জৈব চাষ নিয়ে বিভিন্ন কর্মশালাতে বিভিন্ন মতামত উঠে আসে  এক্ষেত্রে খুব বেশি জৈব সার এর প্রয়োজন হয় না মাত্র ৪০০ কেজি গোবর ও গোমূত্র দিয়ে ১ একর বা ৩ বিঘা ধান চাষ সম্পন্ন হয়  এবং তারা সাফল্যের সাথে করছেন। তারা এর উপর বছর এর পর বছর জৈব এবংপ্রাকৃতিক বস্তু দিয়ে চাষ ও দেশীয় বীজ নিয়ে গবেষণা করেছেন এবং বিষমুক্ত খাদ্য উৎপাদনে সহযোগিতা করছেন এদের মধ্যে একজন ড: সুভাষ পালেকর একজন কৃষক যিনি প্রাকৃতিক কৃষির জন্যে পদ্যশ্রী সম্মানে সম্মানিত হয়েছেন। তার থেকে পরামর্শ নিয়ে ভারত সরকার যেমন প্রাকৃতিক কৃষি চাষে উৎসাহিত ও প্রশিক্ষণ দিচ্ছে এছাড়াও সরাসরি  প্রশিক্ষণ নিয়ে ভারত তথা বাংলাদেশে অনেক কৃষক প্রাকৃতিক কৃষি বা জৈব কৃষি করছেন ও অনেক কে প্রশিক্ষণ দিচ্ছেন। 

প্রকৃতি থেকে প্রাপ্ত বস্তু দিয়ে আমন , বড়ো ,আউস ধান বিশেষ করে বিভিন্ন সুগন্ধি ধান জৈব পদ্ধতিতে চাষ হচ্ছে এবং লাভ বেশি হচ্ছে। দেশীয় প্রজাতির ধান সংগ্রহ করে চাষ করলে সাফল্য আরোও বেশি পাওয়া যায় এবং বীজের খরজ কমে। 

    ১) ধান বীজতলা তৈরী -

    জৈব পদ্ধতিতে ধান চাষের জন্যে এবং সুস্থ সবল রোগমুক্ত চারা উৎপাদনের  জন্যে বীজতলা তৈরির সময় কিছু পদ্ধতি গ্রহণ করতে হয়। বীজতলা তৈরী তিনটি ভাবে করা যায়। মেশিনে রোপনের জন্যে ট্রে পদ্ধতিতে , শুকনো পদ্ধতিতে ও মাটি কাদা করে। সব ক্ষেত্রেই মাটির সাথে জীবাণু নাশক ট্রাইকোডার্মা ভিরিডি মিশাতে হয়। এতে চারার গোড়া রোগ মুক্ত হয় , গোড়া পচে না। এর জন্যে এক কাঠা জমিতে বীজতলা তৈরির জন্যে ২০০ গ্রাম ট্রাইকোডার্মা ভিরিডি প্রয়োগ করতে হয়। নিঁম খৈল কাঠা প্রতি ২ কেজি প্রয়োগ আবশ্যক। 

    শক্তিশালী চারা প্রাপ্তির জন্যে মাটিতে সার প্রয়োগ আবশ্যক। শুকনো মাটিতে বীজতলা করলে মাটি তৈরির সময় কাঠা প্রতি ৪ কেজি ঘন জীবান্মৃত এবং পরবর্তীতে জল দিয়ে ভিজিয়ে দেওয়ার সময় কাঠা প্রতি ২ লিটার জীবান্মৃত জৈব সার জলের সাথে মিশিয়ে প্রয়োগ করতে হয়। কাদা করে বীজতলা করলে কাদা করার সময় কাঠা প্রতি ৪ কেজি ঘন জীবান্মৃত এবং ২ কেজি ২ লিটার জীবান্মৃত দিয়ে কাদা করতে হয়। 

    জেনে নিন কিভাবে তৈরী করতে হয় -

    ক) ঘন জীবান্মৃত তৈরী পদ্ধতি 

    খ) জীবান্মৃত তৈরী পদ্ধতি

    বীজতলা পরিচর্যা করার দরকার হয় নয়তো মূল জমিতে গিয়ে রোগে আক্রান্ত হয় বেশি  তাই রোগমুক্ত রাখার জন্যে গোবর জল ব্যবহার করতে হয় ১০ দিন অন্তর। এর জন্যে প্রতি লিটার জলে ১০০ গ্রাম কাঁচা গোবর গুলিয়ে সকালে রোদে রেখে দিয়ে বিকেলে ছেঁকে নিয়ে বীজতলাতে স্প্রে  করতে হয়। এক কাঠার জন্যে ২.৫ - ৩ লিটার গোবর জল দ্রবনের প্রয়োজন হয়। পোকা আক্রমণ যেন না হয় তার জন্যে নিমাস্ত্র তৈরী করে প্রয়োগ করতে হয় এটিও কাঠা প্রতি ৩ লিটার মিশ্রণ এর প্রয়োজন হয়। 

    জেনে নিন - নিমাস্ত্র তৈরী পদ্ধতি

    ২) ধান বীজ বাছাই ও শোধন -

    ভালো ধান উৎপাদনের জন্যে বীজ বাছাই করে পুষ্ট বীজ অর্থাৎ ধানের ভেতরে সম্পূর্ণ চাল থাকে যেগুলি সেগুলিকে পুষ্ট বীজ বলে। এমনিতে ধান জলে ভেজালে শুধু চিটে গুলো ভেসে ওঠে কিন্তু আধা ভাঙা বা ৩ ভাগ যেগুলো চাল থাকে সেগুলো ভেসে ওঠেনা সেগুলিকে বীজ বাছাই পদ্ধতিতে বাছাই করে নিতে হয়। 

    এখানে ক্লিক করে জেনে নিন - ধান বীজবাছাই ও শোধন পদ্ধতি 

    ধান বাছাই এর পর শোধন করা আবশ্যক নয়তো বীজ বাহিত রোগের কারণে ,গোড়াপচা, খোলা পচা ,বাদামি রোগ ইত্যাদি হয়। এই রোগ প্রতিরোধের জন্যে গোমূত্র দিয়ে অথবা ভালো হয় বিজান্মৃত দিয়ে বীজ ভিজিয়ে অঙ্কুরদগম করে নেওয়া। এই পদ্ধতি গ্রহণের ফলে বীজে রোগ হয় হয়না ,ভালো অঙ্কুরোদগম হয় এবং উৎপাদন ভালো হয়। 

    জেনে নিন ক্লিক করে - বিজান্মৃত তৈরী পদ্ধতি

    ৩) মূল জমি প্রস্তুতি -

    জৈব পদ্ধতিতে ধান রোপনের জন্যে রোপনের পূর্বে সার প্রয়োগ করলে ভালো সুফল পাওয়া যায়। ধান চাষের পূর্বে যদি জমি দু মাস ফাঁকা থাকে তবে ধঞ্চে চাষ করে রাখলে পরে সেটিকে চাষ দিয়ে মাড়িয়ে দিলে সবুজ স্যারের যোগান হয়। যদি ধান চাষের পূর্বে কম সময় থাকে তবে প্রথম চাষের সময় বিঘা প্রতি ৭০ লিটার জীবান্মৃত বা একরে ২০০ লিটার সমস্ত জমিতে মগ দিয়ে নিয়ে ছড়িয়ে দিতে হবে ,তবে জমিতে জল থাকা আবশ্যক। 

    রোপনের জন্যে সর্বশেষ চাষের সময় একই ভাবে জীবান্মৃত প্রয়োগ করতে হবে এবং সেই সাথে বিঘা প্রতি ৫০ কেজি ঘন জীবান্মৃত দিয়ে কাদা করতে হবে। বিঘা প্রতি ১ কেজি ট্রাইকোডার্মা ভিরিডি দিয়ে চাষ করলে ধানের গোড়াপচা রোগ , ব্লাস্ট রোগ ইত্যাদি হওয়ার সম্ভাবনা কমে যায়। 

    ৪) চারা রোপন পদ্ধতি -

    ধানের চারা রোপনের জন্যে ১০ -১২ ইঞ্চি স্কয়ার দূরত্বে লাইন করে ১০ লাইন পর এক লাইন ফাঁকা রেখে একটি করে চারা লাগালে ভালো সুফল পাওয়া যায়। এর ফলে গুছি মোটা হয় পোকার আক্রমণ কম হয় ও উৎপাদন বৃদ্ধি হয়। একটু উঁচু জমি জল কম থাকে সেই জমিতে   শ্রী পদ্ধতিতে ধান চাষ করলে আরো ভালো উৎপাদন পাওয়া যায়। 

    ৫) সার প্রয়োগ 

    রোপনের ২১ দিন পর জীবান্মৃত একবার এবং ২৫ দিন পর ঘন জীবান্মৃত একবার প্রয়োগ করতে হয় রোপনের পূর্বের পরিমানে। ৪৫ দিন পর জীবান্মৃত একবার প্রয়োগ করতে হয়। প্রতি লিটার জলে ১০০ গ্রাম টাটকা গোবর জল সকালে গুলিয়ে রোদে রেখে দিয়ে বিকেলে ছেঁকে নিয়ে স্প্রে করতে হয় ১৫ দিন পর এতে গাছ সতেজ থাকে ও রোগ কম হয়। বিঘা প্রতি ৬০ লিটার গোবর জল নির্যাস এর প্রয়োজন হয় এক বার স্প্রে করতে। 

    ৬) ধান চাষে ঘাস বা আগাছা নিয়ন্ত্রণ -

    ধান চাষ জৈব পদ্ধতিতে করার জন্যে খুব সহজেই ঘাস বা আগাছা নিয়ন্ত্রণ করা যায়। ধান চাষ মূলত উঁচু এবং নিচু দুটি জায়গাতেই হয় অর্থাৎ কোথায় সর্বদা জল থাকে এবং কোথায় সর্বদা জল থাকে না। জল যেখানে সর্বদা থাকে ঘাস কম হয় এবং যেটুকু পরিমান ঘাস হয় সেগুলি এজলা দিয়ে নিয়ন্ত্রণ করা যায়। এজলা মূলত খাল বিলে দেখা যায় এবং পশু খাদ্যের জন্যে এজলা চাষ করা হয়। এজলা ধান জমিতে ছেড়ে দিলে কিছ দিনের মধ্যেই জমি পূর্ণ হয়ে যায় এর ফলে জলের নিচে সূর্যালোক পৌঁছতে পারে না এবং ঘাস কম হয়। ওপর দিকে এজলা ব্যবহার করলে জমিতে নাট্রোজেন এর যোগান হয় এবং ধান কাটার পরে সেগুলি জমিতে থেকে যায় যা পরবর্তী ফসল চাষে নাইট্রোজেন এর ঘাটতি পূরণ করে। ৬ কেজি এজলা থেকে প্রায় ১ কেজি নাইট্রোজেন পাওয়া যায়।

     জেনে নিন -এজলা কি এবং কিভাবে চাষ হয় 

    উঁচু জমিতে ধান চাষ করলে জল কম সময় থাকে এর ফলে ঘাস বেশি হয় এবং নিয়ন্ত্রণের জন্যে চাষীকে খুব চিন্তিত হতে হয় ও খরচ বেশি হয়। এই ক্ষেত্রে চাষী যদি ধান রোপনের ২১ দিন পর ৫-১০ টি পূর্ণ বয়স্ক হাঁস ক্রয় করে এনে দু মাস পালন করে এবং সময়ে সময়ে জমির যেখানে যেখানে ঘাস হয় সেখানে একটু ধান ছিটিয়ে দেয় তবে জমিতে ঘাস থাকে না  এবং গাছের গোড়ায় বায়ু চলা চল বেশি হয় গাছের পাশকাটি বেশি হয় , পোকা মাকড় খেয়ে ফেলে ফলে খরচ কম হয় এবং উৎপাদন বেশি হয়। হাঁস পালনের ফলে দু মাসে যে ডিম্ প্রাপ্তি হয় তা দিয়ে কৃষকের ধান কাটার টাকা উঠে আসে। এই পদ্ধতি শুকনো ও জলা ধান জমি দুটিতেই কৃষক গ্রহণ করলে কৃষকের লাভ অনেকটা বেড়ে যায় আর খরচ কমে যায়। 

    ৭) ধানের রোগ দমন ব্যবস্থাপনা -

    ধানের কয়েকটি রোগের মধ্যে প্রধান রোগ হল ব্যাকটেরিয়াল ব্লাইট রোগ ,পাতার বাদামি দাগ ,খোলা পচা রোগ ,গোড়াপচা রোগ ইত্যাদি এই রোগ সম্পর্ণ ভাবে জৈব পদ্ধতিতে নিয়ন্ত্রণে থাকে যদি প্রথমে বীজ  বীজ তলা এবং ও রোপনের পূর্বে ধানের গোড়া ট্রাইকোডার্মা ভিরিডি দিয়ে শোধন করে নেওয়া হয়। ধানের গোড়া শোধনের জন্ন্যে ১০ লিটার জলে ২০০ গ্রাম ট্রাইকোডার্মা ভিরিডি মিশিয়ে সেই জলে ১০ মিনিট ধান চারার গোড়া ভিজিয়ে নিতে হয় এছাড়াও মূল জমিতে রোগে আক্রান্ত হলে ১৫ লিটার জলে ১০ গ্রাম ট্রাইকোডার্মা ভিরিডি দিয়ে স্প্রে ১৫ দিন অন্তর করলে সম্পর্ণ নিরাময় হয়। 

    এছাড়াও বোর্দ্য দ্রবণ তৈরী করে ব্যবহার করলে ধানের প্রধান রোগ গুলি সম্পূর্ণ নিরাময় হয় জৈব ভাবে।

    ৮) ধানের পোকা দমন পদ্ধতি -

    ধানের পোকা দমনের পূর্বে ধানের পোকা সম্পর্কে একটা স্বচ্ছ ধারণা থাকলে ভালো হয় এবং কোন পোকা কোন সময়ে কতটা ফসল নষ্ট করে। ধান জমিতে মূলত দুটি ধরণের পোকার উপদ্রব দেখা যায় বন্ধু পোকা ও শত্রু পোকা। শত্রু পোকা ফসল নষ্ট করে আর বন্ধু পোকা শত্রু পোকাদের খেয়ে ফসলকে রক্ষা করে। ধান জমিতে শত্রু পোকার তুলনায় বন্ধু পোকা বেশি উৎপন্ন হয় কিন্তু অনেকেই  দু একটি শত্রু পোকা দেখে পোকা নিধনের জন্যে ব্যতিব্যস্ত হয়ে পড়েন  এবং রাসায়নিক কীটনাশক প্রয়োগের করে শত্রু ও বন্ধু দুটি পোকাকেই মেরে ফেলে এর  ফলে পুনরায় শত্রু পোকার উদ্ভব হয় ও ফসল নষ্ট করে। 

    ৮.১) ধানের শত্রু ও বন্ধু পোকা 

    ধানের শত্রু পোকা কে বন্ধু পোকা খেয়ে যেভাবে নিয়ন্ত্রণ করে সেটিকে ৪ টি ভাগে ভাগ করে দেখলে যেটা বুঝতে সহজ হয় সেটি হল -

    ক) ধানের শত্রু পোকা ধানের বাদামি শোষক পোকা ,ধানের লালা পিঠ যুক্ত শোষক পোকা ,ধানের সবুজ শ্যামা পোকা এদের ডিম্ খুঁজে খুঁজে খায় মিরিভ পোকা ,টেরোম্যালিড বোলতা, এনাগ্রস বোলতা ও ড্ৰাইনিভ বোলতা এবং বাড়ন্ত ও পূর্ণাঙ্গ শত্রু পোকা গুলিকে ধরে খায় বেটে মাকড়শা, লম্বা চোয়াল মাকড়শা, লিনাক্স মাকড়শা, নেকড়ে মাকড়শা , ওরব মাকড়শা ,মেতে বিটল পোকা, ক্রিকেট ফড়িং , লেডি বার্ড বিটল , লম্বা শিং ফড়িং , মাইক্রো ভিলিয়া নামক বন্ধু পোকা গুলি। 

    খ) কালো মাথার মাঝরা  পোকা, মাঝরা পোকার কীড়া, হলুদ মাঝরা পোকা, ডোরাকাটা মাঝরা শত্রু পোকাগুলিকে খেয়ে পাতা ফড়িং ,মেসভিলিয়া , মেঠো ঘাস ফড়িং ,গঙ্গা ফড়িং , লিনক্স মাকড়শা ব্ল্যাকনিভ, পিম্পল বোলতা ,নেকড়ে মাকড়শা ,মাইক্রোভিলিয়া ,ক্রিকেট ফড়িং ইত্যাদি ধানের বন্ধু পোকা গুলি। 

    গ) ধানের মশা বা গলমিজ ধানের শত্রু পোকাগুলিকে খেয়ে দমিয়ে রাখে টেরোম্যালিড বোলতা ,প্লাটিগ্যাস্টি বোলতা, নেকড়ে মাকড়শা ,পাতাফড়িং ইত্যাদি ধানের বন্ধু পোকাগুলি। 

    ঘ) ধানের পাতামোড়া শত্রু পোকা  কে খেয়ে দমিয়ে রাখে অড়ব মাকড়শা , লিনক্স মাকড়শা, লম্বা চোয়াল মাকড়শা কেটেসিয়া বোলতা , ক্রিকেট ফড়িং ,পাতা ফড়িং ইত্যাদি ধানের বন্ধু পোকা গুলি। 

    ৮.২) ধানের শত্রু পোকার ক্ষতির সীমা

    বীজতলা থেকে বাড়ন্ত ধানে শত্রু পোকার উপস্থিতি ও ক্ষতির পরিমান -

    ধান চাষ করতে করলে পোকার আক্রমণ হবে স্বাভাবিক কিন্তু দু -চারটি শত্রু পোকা দেখলেই তাকে মারার জন্যে তৎপর হওয়ার প্রয়োজন হয় না সেগুলিকে খেয়ে বন্ধু পোকারা নিয়ন্ত্রণে রাখে তবে পোকা মারার জন্যে নয়  পোকা যেন না আসে তার জন্যে বিভিন্ন পরিবেশ বান্ধব ব্যবস্থা ও ভেষজ জৈব কীটবিতারক ব্যবহার করা যায় আগে থেকেই এবং আক্রমণের পরেও সেগুলি দিয়ে রোগ নিয়ন্ত্রণে রাখা যায়। শত্রু পোকা আক্রমণে ফসলের কতটা ক্ষতি হয় তা নিন্মে আলোচিত হল -

    ক) বীজতলাতে 

    ভেপু ,মাঝরা ও চিরুনি পোকা আক্রমণে ক্ষতির সীমা মাঝারি থেকে তীব্র। 

    খ) রোপন করার সময় 

    • পাতামোড়া পোকা আক্রমণে ক্ষতির সীমা ২% গুছি আক্রান্ত হয়। 
    • মাঝরা পোকা আক্রমণে ক্ষতির সীমা গুছিতে ১ টি পাতা আক্রান্ত হয়। 
    • সবুজ শ্যামা পোকা আক্রমণে ক্ষতির সীমা গুছিতে ৫-১০ টি পোকা দেখা যায়। 
    • ভেঁপু পোকা আক্রমণে ক্ষতির সীমা গুছিতে একটি পেঁয়াজ কলির মতো পাতা দেখা যায়। 
    • পামরি পোকা আক্রমণে ক্ষতির সীমা গুছিতে ১ টি পাতাতে পোকা দেখা যায়। 

    গ) পাশকাঠি ছাড়ার মাঝামাঝি সময় 

    • মাঝরা পোকা আক্রমণে ক্ষতির সীমা গুছিতে ৫% শুকনো মাঝে পাতা  দেখা যায়। 
    • ভেঁপু পোকা আক্রমণে ক্ষতির সীমা গুছিতে ৫% পাশকাঠি আক্রান্ত হয়। 
    • পামরি পোকা আক্রমণে ক্ষতির সীমা গুছিতে ১-২ টি পাতা আক্রান্ত ও একটি পোকা দেখা যায়। 
    • চুঙ্গি পোকা আক্রমণে ক্ষতির সীমা গুছিতে ১-২ টি পাতা চোঙের মতো হয়। 
    • সবুজ শ্যামা পোকা আক্রমণে ক্ষতির সীমা গুছিতে ৫-১০ টি পোকা দেখা যায়। 
    • পাতামোড়া পোকা আক্রমণে ক্ষতির সীমা গুছিতে ১-২ টি পাতা মোড়া পাতা দেখা যায়। 

    ঘ) ধান গাছে থোর আসার সময় 

    মাঝরা পোকা আক্রমণে ক্ষতির সীমা প্রতি বর্গমিটারে ৪-৫% মরা পাতা দেখা যায়। 

    ঙ) শীষ বেড়োনোর সময় -

    • মাঝরা পোকা আক্রমণে ক্ষতির সীমা প্রতি বর্গ মিটারে একটি মোড়া শীষ দেখা যায়। 
    • বাদামি শোষক পোকা আক্রমণে ক্ষতির সীমা গুছিতে ৫-১০ টি পোকা দেখা যায়। 
    • শীষ কাটা লেদা পোকা আক্রমণে ক্ষতির সীমা গুছির গোড়ায় ১-২ টি লেদা পোকা দেখা যায়। 
    • গান্ধী পোকা আক্রমণে ক্ষতির সীমা গুছিতে একটি বা দুটি গান্ধী পোকা দেখা যায়। 

    ৮.৩) পরিবেশগত ভাবে ধানের পোকা নিয়ন্ত্রণ -

    ধানের শত্রু পোকা নিয়ন্ত্রণের জন্যে ধান জমিতে পাখি বসার জন্যে বাসের ঝড়  যুক্ত মাথা, গাছের ডাল দাঁড় করিয়ে দিলে বা ধঞ্চে গেড়ে দিলে পাখি বসে ধানের পোকা ধরে ধরে খায় এবং পোকা নিয়ন্ত্রণ হয় একে বলে বার্ডপাচ্চার পদ্ধতি। এটি করার জন্যে বিঘা প্রতি ৪০-৫০ ধঞ্চে গাছ বা বাসের ঝার যুক্ত মাথা বা গাছের ডাল ২০-৩০ পুঁতে দিতে হয়। 

    গান্ধী পোকা নিয়ন্ত্রণের জন্যে ফুল আসার সময় বিঘা প্রতি ২০-২৫ টি শামুক বা কাঁকড়া থেঁতো করে ২ -৩ হাত লম্বা বাসের কাঠির মাথায় রেখে দিতে হবে ২০-২৫ টি বাসের কাঠিতে এতে গান্ধী পোকা পচা কাঁকড়া বা শামুকে আকৃষ্ট হয় এবং ভোরবেলায় ঢোঙায় ভোরে মেরে ফেলতে হয় অথবা ২০-২৫ টি গান্ধী পোকা ধরে থেঁতো করে ১ লিটার জলে মিশিয়ে গান্ধীপোকা আক্রান্ত জমিতে স্প্রে করলে প্রায় ১০ দিন এই পোকার উপস্থিতি বন্ধ হয়ে যায়। পুনরায় আক্রমণ হলে পুনরায় স্প্রে করতে হয় একই ভাবে। 

    ধানের গান্ধী পোকা, লেদা পোকা , মাজরা পোকা ,কারেন্ট পোকা ,শোষক পোকা ও  অন্যান্য  শত্রু পোকা নিয়ন্ত্রণের জন্যে ৭ -১৫ দিন অন্তর পোকা আক্রমণ করলে বা না করলেও ভেষজ কীটনাশক হিসাবে অগ্নিঅস্ত্র তৈরী করে স্প্রে করলে পোকা নিয়ন্ত্রণে থাকে। এছাড়াও মাজরা পোকা নিয়ন্ত্রণের জন্যে যদি কীটবিতারক দিয়ে কাজ না হয় তবে বিঘা প্রতি ১ লিটার কেরোসিন  তেল ২ কেজি বালুর সাথে সমস্ত জমিতে ছিটিয়ে দিয়ে জমির দু পাস্ থেকে দুজন দড়ি ধরে ধানের উপর দিয়ে টান দিলে ধানে লেগে থাকা মাজরা পোকাগুলি মাটিতে পরে গিয়ে নষ্ট হয়ে যায় এর জন্যে জমিতে অল্প জল থাকা আবশ্যক।   

    জেনে নিন -  অগ্নিঅস্ত্র তৈরী পদ্ধতি

    ৯) ধানের সাথে সাথী ফসল চাষ -

    ধান রোপনের পর ধান জমিতে জল থাকার কারণে অন্য কোনো সবজি চাষ করা যায় না ধারণা থাকলেও একটু চেষ্টা করলেই করা যায় এবং সেই সময়ে কম সবজি উৎপাদন করলেই ভালো লাভ হয় কারণ দাম বেশি থাকে তাই এই সময়ে ধান জমিতে ১০ -১৫ ফুট পর পর ধান চারা রোপনের পর আগে বস্তায় সার ও মাটি মিশ্রণ করে ধান জমিয়ে বসিয়ে দিতে হয় এবং বস্তা যেন না হেলে পরে যায় তার জন্যে একটি বাশ গেড়ে ঝড় যুক্ত বাসের আগাল গেড়ে দিয়ে বস্তা বেঁধে দিতে হয়। সাথী ফসল হিসাবে ঝিঙ্গা , শশা ,দুৎকুষি , কোয়াস ,করলা ,ছোট জাতের লাউ অন্যত্র চারা করে বা সরাসরি বস্তায় দুটি করে রোপন করলে সেগুলি বড়ো হয়ে বাসের আগাল ঝেঁকে ধরে ও ফল আসে। 

    এতে লাভ ওই বাসের মাথায় বসে পাখিরা পোকা ধরে ধরে খায় এবং একই সময়ে একই জমি থেকে দ্বিগুন পরিমানে অর্থ লাভ করা যায়। 

    এছাড়াও বেশিভাগ সময়ে জল থাকে নিচু ধান জমির আল বা ধার উঁচু করে এক সাইডে নালা বা মাঠখাল করে আলের চারিদিকে নেট দিয়ে ঘেরে মাছ চাষ করা ,হাসপালন করা যায় এতে খাদ্য কম লাগে গোড়ার পোকা মাকড় খেয়ে ফেলে খরচ কম হয়। ধানের জমিতে শেষের দিকে ডাল বা তৈল বীজ ফেলে দিলে বিনা চাষে পরিবর্তী ফসল হিসেবে এই জাতীয় ফসল চাষ হয় যেটিকে পয়রা চাষ বলা হয় । 

    ১০) FAQ (প্রায়ই জিজ্ঞাসিত প্রশ্ন উত্তর)

    ১) ধান চাষে প্রধান জৈব সার কোনটি ?

    ধান চাষের প্রধান জৈব সার জীবান্মৃত। এই সার কম খরচেই বাড়িতে তৈরী করে প্রয়োগ করলে ৫ দিন পর থেকে গাছের চেহারা পরিবর্তন হতে থাকে এবং এক মাসে চাষ জমির অনেক পরিবর্তন দেখা যায়।  ধীরে ধীরে জমিতে কার্বন শক্তি ও উপকারী জীবাণু বাড়তে থাকে এবং ধানের উৎপাদন ও ওজন বেশি হয়। খাদ্যের পুষ্টিমান বৃদ্ধি হয়। 

    ২) ধানে জৈব কীটনাশক গুলি কি কি ?

    ধানে সবচেয়ে সহজভাবে তৈরী নিঁম, রসুন ,লঙ্কা ,গোমূত্র ,গোবর দিয়ে তৈরী নিমাস্ত্র ,অগ্নিঅস্ত্র। 

    ৩) ধানের কারেন্ট পোকা দমন কিভাবে করা যায় ?

    কৃষ্ণ পক্ষ ও শুক্ল পক্ষ প্রতি পক্ষে দুই বার করে বিঘা প্রতি দুটি জায়গায় আগুন জ্বালিয়ে কারেন্ট পোকা শ্যামা পোকা সহজেই নিয়ন্ত্রণ করা যায়। 

     ১১) তথ্যসূত্র -

    ক) ড: সুভাষ পালেকর পদ্যশ্রী পুরস্কার প্রাপ্ত কৃষক। 
    ২) লোক কল্যাণ পরিষদ কলকাতা।   

    একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

    0মন্তব্যসমূহ

    একটি মন্তব্য পোস্ট করুন (0)