শোল মাছের উপকারিতা ও পুষ্টিগুণ বৈশিষ্ট্য

Didibhai Agrofarm
0
শোল মাছের শ্লেষ্মা এবং টিস্যুর নির্যাসে উচ্চ পরিমাণে অ্যামিনো অ্যাসিড বিশেষ করে গ্লাইসিন এবং অ্যারাকিডোনিক অ্যাসিড পাওয়া যায়। এই দুটি ক্ষতিগ্রস্থ টিস্যুতে কোলাজেন সংশ্লেষণ এবং পুনরায় এপিথেলিয়ালাইজেশন শুরু করে শরীরের ক্ষত নিরাময়কে উন্নীত করে।


শুধুমাত্র সুস্বাদু বা স্বাস্থকর জন্যে মাছকে খাদ্য হিসাবে গ্রহণ করা হয় না। এর বাইরেও বিভিন্ন রোগের ঔষধ হিসাবে মাছের বিভিন্ন অংশ ব্যবহার করা হয়। আমরা যেমন জানি যে  বিভিন্ন সামুদ্রিক মাছের ঔষধি দ্রব্য যেমন হাঙ্গর কার্টিলেজ, কড লিভার অয়েল ক্যাপসুল,  ইত্যাদি রোগীদের জন্য সুপারিশ করা হয় তেমন ভাবে মিষ্টি জলের মাছ যেমন শোল ,ক্যাটফিশ ইত্যাদি মাছ মানুষের বিভিন্ন রোগ নিরাময় করে আমাদের কাছে পরিচিত নয়। মিষ্টি জলের মাছের ঔষধি গুন্ ব্যাপক ভাবে সকলের কাছে পরিচিত নয়। শোল মাছের ঔষধি পুষ্টি গুন্ সম্পর্কে সকলে পরিচিত নই যেটা জানলে আমাদের মৎস খাদ্য তালিকায় ও ঔষধি ব্যবহারে গুরুত্ব পূর্ণ জায়গা নিবে বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। শোল সেবনে ও শোল পণ্য ব্যবহারে বিভিন্ন ক্ষত ও শরীর দুর্বলতা কাজে লাগে। ডোরাকাটা শোলে একটি ঔষধি স্বাদু জলের মাছ হিসেবে বিবেচিত হয় কারণ এর মাংসে অ্যালবুমিন, অ্যামিনো অ্যাসিড (গ্লাইসিন, লাইসিন, আরজিনাইন) এবং ফ্যাটি অ্যাসিড (অ্যারাকিডোনিক অ্যাসিড 20:4n-6) এর মতো প্রচুর পরিমাণে জৈব সক্রিয় উপাদান রয়েছে। অ্যান্টিনোসিসেপশন, গ্যাস্ট্রোপ্রটেকশন, রোগ প্রতিরোধ, অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট এবং ক্ষত নিরাময় প্রক্রিয়ায়। সুস্বাস্থ্য বজায় রাখতে এবং দীর্ঘস্থায়ী অসুস্থতার পরে শারীরিক দুর্বলতা দূর করে শক্তি অর্জন করতে শোল মাছে সমস্ত প্রয়োজনীয় উপাদান রয়েছে।

    ১) পরিচিতি :-

    শোল মাছ সকলের কাছে অতিপরিচিত মিষ্টি জলের একটি সুস্বাদু পুষ্টিগুণ সপূর্ণ মাছ। বিভিন্ন জায়গায় বিভিন্ন নাম পরিচিত।  আফ্রিকা ,উত্তর আমেরিকা ,দক্ষিণ চীন ,এশিয়ার বিভিন্ন দেশ ভারত পাকিস্তান বাংলাদেশের বহুল প্রচলিত এবং উচ্চ মূল্যের পছন্দের মাছ। শোল চান্নিদি পরিবারের স্ট্রিয়াটা প্রজাতির চান্নি জেনাস মাছ। শোল মাছের  বিজ্ঞানসম্মত নাম চান্নিদি স্ট্রিয়াটা।  এটি সাধারণত মিষ্টি জলের খাল ,বিল ,পুকুর ,নদী,নালা ধান ক্ষেতের মধ্যে থাকতে দেখা যায়। 

    শোল মাছ ভাড়তের মিষ্টি জলের সুস্বাদু জনপ্রিয় মাছেদের মধ্যে একটি। ভারতের বিভিন্ন রাজ্য যেমন অন্ধ্রপ্রদেশ ,তেলেঙ্গানা ,তামিলনার ,হরিয়ানা ,পাঞ্জাব এবং দেশের উত্তর পূর্বাঞ্চল রাজ্যগুলি পশ্চিমবঙ্গ ,আসাম ত্রিপুরাতে একটি উচ্চ মূল্যের খাদ্য তালিকায় থাকে। বাংলাদেশেও বহুলপ্রচলিত সুস্বাদু মিষ্টি জলের  ও উচ্চ মূল্যের পছন্দের মাছ। 

    শোলমাছ বিভিন্ন ভাষা ও বিভিন্ন জায়গায় যেমন  ইংলিশে মুরেল স্নেকহেড , হিন্দিতে মুরাই ,তেলুগুতে কোরামাণু ,কোরামাট্টা ,মালয়ালম তে কোরাভা, ভাটন,ভারাল , বাংলায় শোল ,ওরিয়াতে গদিশা,অসমীয়াতে হাল ,মারাঠিতে মারাল নাম পরিচিত। 

    ২) শোল মাছের বৈশিষ্ট্য :-

    • শোল মাছ দেখতে সাপের মতো বড়ো মাথাটি এবং মাথার পৃষ্ঠে বড়ো প্লেটে মতো অ্যাশ রয়েছে তাই একে সাপের মাথার মাছও বলা হয়ে থাকে । 
    • শরীরের রং উপরে ধূসর সবুজ এবং পাশে হলুদ ফ্যাকাশে রঙের হয়ে থাকে। পাখনা গুলো মেরুদন্ড ছাড়া হাইলাইন থাকে। গাঢ় ছোপযুক্ত পৃষ্ঠীও ও পায়ুর পাখনা গুলি দীর্ঘ হয়। পুচ্ছ পাখনা গুলি আকৃতিতে গোলাকার হয়। জোড়া পাখনা গুলি ফ্যাকাশে হয়। 
    • এটি ৩ ফুট লম্বা ও ৩ কেজি ওজন পর্যন্ত বৃদ্ধি পায়। 
    • যতক্ষণ পর্যন্ত স্বাশ ও প্রস্বাসের যন্ত্রাংশ আদ্র থাকে ততক্ষন পর্যন্ত শুকনায় বেঁচে থাকে। শোল পূর্বাভাসযুক্ত ও অত্যন্ত মাংসাশী একটি মাছ। 
    • এরা উভচর ও জলজ জীবন্ত প্রাণীর লার্ভাদের জীবন্ত খেতে পছন্দ করে।
    •  ছোট অবস্থায় এরা শেওলা ,প্ল্যাঙ্কটন ও ছোটোজোয়ানকে খাদ্য হিসেবে খায়। 
    আরও দেখুন- Ornamental fish রঙিন মাছের নাম ,ছবি ,চাষ ,খাবার ও রোগের চিকিৎসা পদ্ধতি -2022

    ৩) শোল মাছের উপকারিতা :-

    ক) শোল মাছের শ্লেষ্মা এবং টিস্যুর নির্যাসে উচ্চ পরিমাণে অ্যামিনো অ্যাসিড বিশেষ করে গ্লাইসিন এবং অ্যারাকিডোনিক অ্যাসিড পাওয়া যায়। এই দুটি ক্ষতিগ্রস্থ টিস্যুতে কোলাজেন সংশ্লেষণ এবং পুনরায় এপিথেলিয়ালাইজেশন শুরু করে শরীরের ক্ষত নিরাময়কে উন্নীত করে। তাই গর্ভাবস্থার পরে ক্ষত নিরাময় করে পুনরায় একই রকম করে দেওয়ার জন্য শোলের নির্যাস সুপারিশ করা হয়। এর কারণ শোল মাছে  পর্যাপ্ত পরিমানে ফ্যাটি অ্যাসিড এবং অ্যামিনো অ্যাসিড ও ছাই থাকে।

    খ) একজিমার মতো চর্মরোগের চিকিৎসায় ব্যবহৃত হয় শোল মাছ। 

    গ) শোল মাছ খেলে ব্যাথা জ্বালা থেকে মুক্তি পাওয়া যায়। 

    ঘ) শোল মাছ সারা পৃথিবীর লোক বাতের ব্যাথার উপশমের জন্যে ব্যবহার করত। 

    ঙ) শোল মাছ শরীরে অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট বৃদ্ধি করে। সাধারণভাবে মাছ হল অ্যান্টিঅক্সিডেন্টের একটি গুরুত্বপূর্ণ উৎস। শোল মাছ মিষ্টি জলের  অন্যতম প্রধান মাছ যা অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট ক্রিয়াকলাপের অধিকারী, অ্যামিনো অ্যাসিড এবং ফ্যাটি অ্যাসিড লাইপোফিলিক অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট বেশি উৎপাদন করে যা কার্যকর ভাবে ওমেগা 3 এর অক্সিডেশনের বিরুদ্ধে কাজ করে। 

    চ) কার্ডিওলজিক্যাল এর ক্ষেত্রে শোল মাছের প্রভাব আছে জানা যায়। শোল মাছ হাইপারটেনসিভ রোগীদের জন্য একটি কার্যকরী খাদ্য এবং প্রতিরোধমূলক ওষুধ। শোল ফিশ স্কিন এক্সট্রাক্ট নামক ত্বকের নির্যাসটিতে শক্তিশালী সক্রিয় যৌগ, কার্ডিওটক্সিক ফ্যাক্টর পাওয়া গেছে, যা  হাইপোটেনসিভ প্রভাব এবং কার্ডিওটক্সিক বৈশিষ্ট্য যা কার্ডিয়াক মার্কার এনজাইম ক্রিয়েটাইন ফসফোকিনেস এবং ক্রিয়েটাইন বৃদ্ধিকে প্রভাবিত করে। মাছের তেলের পরিপূরক এখন ব্যাপকভাবে কার্ডিওভাসকুলার সমস্যার বিরুদ্ধে একটি কার্যকর প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা হিসাবে বিবেচিত হয়।

    ছ) শোল মাছের ত্বকের নির্যাস সেরোটোনার্জিক রিসেপ্টর সিস্টেমকে প্রভাবিত করে তাই তারা অ্যান্টি-ডিপ্রেসেন্ট হিসেবে স্নায়বিক কাজ করে। 

    জ) শরীর অসুস্থের পরে দুর্বলতা দূর করে শক্তি অর্জন শক্তি অর্জন করতে শোল মাছের পুষ্টিগুণ অনেকাংশে কার্যকরী।  

    আরও দেখুন-  মাছ সংরক্ষণ কৌশল

    ৪) শোল মাছের ও পুষ্টিগুণ :-

    ১০০ গ্রাম তাজা শোল মাছে পুষ্টির পরিমান নিন্মে উল্লেখ করা হয়েছে-

    ক) ভিটামিন :-

    ১০০ গ্রাম তাজা শোল মাছে ভিটামিন এ থাকে ৩.৩৯ আই.ইউ. এবং ভিটামিন ডি থাকে ১৯৩.৫০  আই.ইউ।  

    খ) প্রক্সিমেট কম্পোজিশন :-

    ১০০ গ্রাম তাজা শোল মাছে আদ্রতা ৭৬.১১ গ্রাম ,প্রোটিন ১৪.৪৬ গ্রাম,ফ্যাট ২.১৫ গ্রাম এবং ছাই ২.২৮ গ্রাম থাকে।

    গ) খনিজ পদার্থ :-

    ১০০ গ্রাম তাজা শোল মাছে ক্যালসিয়াম ১৪৮.৭ মিলিগ্রাম,সোডিয়াম ৩.৯৭ মিলিগ্রাম ,পটাসিয়াম ১৭.০৬ মিলিগ্রাম, আয়রন  ০.০৫৪ মিলিগ্রাম, ম্যাঙ্গানিজ ০.০৫৬ মিলিগ্রাম, জিঙ্ক ০.০১৯ মিলিগ্রাম, কপার ০.০৫৬ মিলিগ্রাম থাকে।

    ঘ) ক্যালোরিস :-

    ১০০ গ্রাম তাজা শোল মাছে ক্যালোরি ৮১.১৩ Kcal ( ৩৩৯.১২ kj ), কার্বোহাইড্রেড ০.০ Kcal/kj ,  ফ্যাট ১৯.৩৯ Kcal ( ৮১.০৫ kj ), প্রোটিন ৬১.৭৪ Kcal ( ২৫৮.০৭ kj ) পরিমানে থাকে। 

    ঙ) অ্যামিনো অ্যাসিড :-

    ১০০ গ্রাম তাজা শোল মাছে আরজিনাইন ৭.২৩ মিলিগ্ৰাম , হিস্টিডিন ১৪.৪৬ মিলিগ্ৰাম ,আইসোলিউসিন ১৭.৩৫মিলিগ্ৰাম, লিউসিন ৬০.৭৩ মিলিগ্ৰাম, লাইসিন ৭.২৩ মিলিগ্ৰাম ,মেথিওনিন ৭.২৩মিলিগ্ৰাম ,ফেনিলানাই ৭.২৩মিলিগ্ৰাম, থ্রোনাইন ৮.৬৮ মিলিগ্ৰাম, ট্রিপটোফান ২৯২.০৯ মিলিগ্ৰাম , ভ্যালাইন ২৪.৭৮ মিলিগ্ৰাম, অ্যাসপার্টিক অ্যাসিড ১১৬৪.০৩ মিলিগ্ৰাম , সেরিন ১৩.০১ মিলিগ্ৰাম ,গ্লুটামিক অ্যাসিড ৫৬.৩৯ মিলিগ্ৰাম ,প্রোলিন ১৭৯.৩০ মিলিগ্ৰাম , গ্লাইসিন ৮.৬৮ মিলিগ্ৰাম, অ্যালানাইন ২৬.০৩ মিলিগ্ৰাম , সিস্টাইন ২৭.৪৭ মিলিগ্ৰাম, টাইরোসিন ৭.২৩ মিলিগ্ৰাম, গ্লুটামিন ১৮২.২২ মিলিগ্ৰাম এবং অ্যাসপারাজিন ৬৫৫.০৪ মিলিগ্ৰাম পরিমান করে থাকে। 

     চ) ফ্যাট এবং ফ্যাটি অ্যাসিড :-

    ১০০ গ্রাম তাজা শোল মাছে মোট ফ্যাট ২.১৫ গ্রাম , স্যাচুরেটেড ফ্যাট ১.১৪ গ্রাম , মনোস্যাচুরেটেড ফ্যাট ০.৬৮ গ্রাম এবং পলিআনস্যাচুরেটেড ফ্যাট ০.৩৫ গ্রাম পরিমানে থাকে। 

    আরও দেখুন-  শোল মাছের চাষ ও প্রজনন প্রযুক্তি -পুকুরে/ট্যাঙ্কে

    ৫) উপসংহার   

    শোল মাছ একটি মিষ্টি জলের পুষ্টিগুণ সম্পূর্ণ ঔষধি মাছ যা বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বসবাস করে এবং ক্ষতের চিকিৎসা, ব্যথা উপশম এবং শক্তি বৃদ্ধির জন্য ওষুধ হিসেবে ব্যবহৃত হয় এছাড়াও স্নায়বিক রোগের চিকিৎসায় এবং অঙ্গ ও কোষের পুনরুত্থান সম্ভাবনা বাড়িয়ে দিতে সাহায্য করে।

    তথ্য সূত্র :- 

    • ICAR- সেন্ট্রাল ইনস্টিটিউট অফ ফ্রেশ ওয়াটার একুয়াকালচার (CIFA)। 
    • বায়োমেডিকেল সায়েন্স বিভাগ, বিশ্ববিদ্যালয় পুত্র মালয়েশিয়া। 

    FAQ

    ১) শোল মাছ খেলে কি হয় ?

    শোল মাছে খেলে অসুস্থতার পর দ্রুত  শারীরিক সক্ষমতা বৃদ্ধি হয়। ক্ষতস্থানে দ্রুত মাংস বৃদ্ধি হয়ে পূর্ণ করে দেয়। বাতের ব্যাথায় কার্যকরী ফল পাওয়া যায়। 

    ২) স্বপ্নে শোল মাছ ধরতে দেখলে কি হয় ?

    স্বপ্নে শোল মাছ ধরতে দেখলে দ্রুত সাফল্য অর্জনের সংকেত বুঝায় আদিকাল থেকে একটি ধারণা চলে আসছে তবে এর সাথে বাস্তবতার কোনো মিল আছে কি না তা জানা যায়নি। 

    ৩) শোল মাছের ইংলিশ নাম কি ?

    শোল মাছের ইংলিশ নাম মুড়েল ফিশ আবার মাথা ও চোখ সাপের মতো দেখতে হাওয়ায় কোথাও কোথাও একে স্নেক হেড ফিশ বলা হয়। শোল মাছের বিজ্ঞান সম্মত নাম চান্না স্ট্রিয়াটা।   


    আরও দেখুন

    একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

    0মন্তব্যসমূহ

    একটি মন্তব্য পোস্ট করুন (0)