গলদা চিংড়ি মাছ চাষ করার নিয়ম

Didibhai Agrofarm
0

 গলদা চিংড়ি মাছ চাষ করার নিয়ম 

গলদা চিংড়ি চাষের পদ্ধতি, গলদা চিংড়ি চাষের পূর্বে জল ও মাটি পরীক্ষা, গলদা চিংড়ির খাদ্য তালিকা, গলদা চিংড়ির রোগ ও প্রতিকার, গলদা চিংড়ি উৎপাদন

গলদা চিংড়ি চাষ খুব লাভজনক একটা ব্যবসা এবং এর চাষ খুব একটা সমস্যার নয়। চিংড়ির বর্তমান প্রজাতিগুলোর মধ্যে সবচেয়ে পরিচিত ও জনপ্রিয় হল গলদা চিংড়ি (ম্যাক্রোব্রাকিয়াম রোজেনবার্গি)। গলদা চিংড়ি চাষের জন্য দরকার উপযুক্ত পরিমাণ খাবার ও পুকুর পরিচালনা। গলদা চিংড়ি সর্বভূক প্রাণী, এর খাদ্যের অভাব হলে বৃদ্ধি কমে যায়। সেই জন্য সবসময় খাদ্যের সুবন্দোবস্ত করা উচিত এবং পুকুরের মধ্যে ছোট ছোট আশ্রয় বা লুকোনোর বন্দোবস্ত করা উচিৎ যাতে চিংড়ি সেখানে বাসা বাঁধতে পারে। CULTURE OF MACROBRACHIUM ROSENBERGII

     ১)  গলদা চিংড়ি চাষের পদ্ধতিগুলি হল :-

    ক) পুকুর নির্বাচন : -

    পরিমিত পরিমাণ জল সব সময় থাকে এইরূপ জায়গা পছন্দ করা উচিৎ। পুকুরের তলদেশে কম পাঁক থাকা উচিৎ। জল পরিস্কার ও কীটনাশক মুক্ত হওয়া প্রয়োজন। আদর্শ পুকুরের আয়তন ২৫ শতক থেকে ১৫০ শতক এবং জলের গভীরতা ১.০-১.৫ মিটারের মধ্যে হওয়া বাঞ্ছনীয়।

    খ) পুকুর প্রস্তুতি :-

    পুকুর অল্প একটু ঢালু হওয়া উচিৎ যাতে চিংড়ি খুব সহজে ধরা যায়। পুকুরে তলদেশে যে নরম শৈবালের আস্তরণ পড়ে তা চিংড়ির প্রিয় খাদ্য। পুকুরে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র প্রাণীকণা (zooplankton) উৎপাদনের জন্য জৈব সারের বন্দোবস্ত করা উচিত যেগুলি হল মুরগীর মল, শুকর এবং গবাদি পশুর মলমুত্র ইত্যাদি। নতুন কাটানো পুকুরে গোবর সার অবশ্যই প্রয়োগ করতে হবে। পুকুরের জলে অবাঞ্চিত মাছ মারার জন্য মহুয়া খোল প্রয়োগ করতে হয়। পুকুর প্রস্তুতির সময় চুন প্রয়োগ একান্তভাবে দরকার যার পরিমাণ হল বিঘা প্রতি ২৮-৪০ কেজি।

    গ) গলদা চিংড়ি চাষের পূর্বে জল ও মাটি পরীক্ষা :-

    চিংড়ি চাষের জন্য দূষণমুক্ত জলের প্রয়োজন। প্রয়োজনীয় জলের মূল গুণাগুণ গুলি হল তাপমাত্রা ২৬-৩২ ডিগ্রী সেন্টিগ্রেড (Ph"7-8.5, Do> 158ppm. Ca→ 30-80ppm, NH N 0.2-2ppm) জলের অক্সিজেনের পরিমাণ বাড়ানোর জন্য বায়ু সঞ্চালন যন্ত্রের প্রয়োজন হয়। জলের প্রয়োজনীয় গুণাগুন গুলি মাঝে মধ্যে পর্যালোচনা করা উচিৎ। জলের গুণাগুন ঠিক রাখার জন্য জলের (Ph) সব সময় ক্ষারীয় হওয়া উচিত। মাঝে মধ্যে পুকুরের জল পরিবর্তন করা উচিৎ এবং এই পরিবর্তনের মাধ্যমে অপ্রয়োজনীয় গ্যাসের ক্ষতিকারক ক্ষমতা কমে যায়। চিংড়ির চারা মজুতের আগে পুকুরের প্রাকৃতিক খাদ্যকণার পর্যবেক্ষণ করা উচিৎ, সাধারণত এই সময় জলের রং কালচে সবুজ হয় ।

    ঘ) গলদা চিংড়ির চারা মজুত :-

    ভাল ফলন পেতে হলে ৫-৭ সেমি দৈর্ঘ্যের সুস্থ সবল গলদা চিংড়ির চারা মজুত করা উচিত, পুকুরে চারা মজুত করার সংখ্যা নির্ভর করে কোন ধরণের চাষের ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে তার উপর। একক ভাবে চিংড়ির চাষের জন্য মজুতের সংখ্যা হওয়া উচিত ৪০০০-৬০০০ প্রতি বিঘা। চিংড়ির চারা মজুতের পূর্বে কমপক্ষে ১৫ মিনিট চারা সহ প্লাস্টিক প্যাকেটটি পুকুরের জলে ধাতস্ত করতে হয়। অন্যথায় চিংড়ির চারা তাপমাত্রায় তারতম্যে / পার্থক্যে মারা যেতে পারে।

    ঙ) গলদা চিংড়ির খাদ্য তালিকা :-

    চিংড়ি সর্বভূক প্রাণী। খাবার হিসাবে দেওয়া হয় ভাঙা চাল, সিদ্ধ ভাত, গম, ময়দা, বাদাম বা সরিষার খৈল ইত্যাদি এবং প্রাণী খাদ্যের মধ্যে দেওয়া হয় শুকনো মাছের গুঁড়ো, কুচো চিংড়ির গুঁড়ো ইত্যাদি। ১০-২০ শতাংশ হারে এই খাবার দুই বারে নির্দিষ্ট সময়ে সকালে ও বিকালে দেওয়া হয়।

    চ) গলদা চিংড়ির পুকুরে  সার প্রয়োগ  :-

    পুকুরে প্রাকৃতিক খাবার বৃদ্ধির জন্য বা খাদ্যের যোগান ঠিক রাখার জন্য প্রতি ১৫ দিন ব্যবধানে যথাক্রমে গোবর সার বিঘা প্রতি ৪০ কেজি এবং সিংগেল সুপার ফসফেট ৪ কেজি ব্যবহার করা যেতে পারে। এছাড়াও বিশেষ খাদ্যের জন্যে বিচালি বা খড় বেঁধে নিয়ে বিঘা প্রতি ১০-১২ কেজি দেওয়া যেতে পারে এতে ৪০% খাদ্যের যোগান পাওয়া যায়। 

    ছ) গলদা চিংড়ির পুকুরে চুন প্রয়োগ ও পরিচর্যা :-

    পুকুরে জলের ক্ষারত্ব বজায় রাখার জন্য প্রথমে বিঘা প্রতি ২৮-৪০ কেজি চুন প্রয়োগ করতে হয় এবং পরবর্তীকালে প্রতিমাসে ৭-১৪ কেজি চুন প্রয়োগ করতে হয়। পোনা ছাড়ার ২ মাস পর থেকে মাসে একবার ৩ ফুট জলের গভীরতায় বিঘা প্রতি ৪ কেজি চুন এবং ১ কেজি মোলাসেস বা চিটে গুড় ব্যবহার করলে ভালো ফল পাওয়া যায় রোগ বালাই কম হয়। 

    জ) গলদা চিংড়ি উৎপাদন :-

    সাধারণত ৫-৮ মাসে ৫০-১৫০ গ্রাম চিংড়ি বৃদ্ধি হয়। চিংড়ি বাঁচার শতকরা হার হল ৪০-৬০ শতাংশ। এই সময়ে মোট চিংড়ির উৎপাদন বিঘা প্রতি ১০০ কেজি থেকে ২০০ কেজি ফলন আশা করা যেতে পারে।

    ২) গলদা চিংড়ির রোগ ও প্রতিকার :-

    ক) গলদা চিংড়ির শ্যাওলা পড়া রোগ ও প্রতিকার:-

    চিড়ির ফুলকার খোলসে শ্যাওলা জমা হয়। এর নামগুলি হল জুথামনিয়াম, এপিস্টাইলিস এবং ভার্টিসেল্লা। এর জন্য ১৫-২৫ পি.পি.এম. হারে ফর্মালিন জলে ছড়িয়ে দিতে হবে এবং জলে দ্রবীভূত অক্সিজেন ৮ পি.পি. এম এর বেশি হতে হবে।

    খ) গলদা চিংড়ির নরম খোলস রোগ রোগ ও প্রতিকার :-

    অনুপযুক্ত খাদ্য প্রয়োগ ও মাটির কম পি. এইচ এর জন্য এই রোগ হয়। প্রতিকার হিসাবে পুকুরে চুন প্রয়োগ (আগের মতো পরিমাণে) এবং এর সাথে ক্যালসিয়াম ও ফসফরাস জাতীয় খাদ্য প্রয়োগ করা উচিত ।

    গ) গলদা চিংড়ির বাদামী দাগ রোগ ও প্রতিকার :-

    এই রোগের কারণ হল সিউডোমোনাস জাতীয় ব্যাকটেরিয়া। প্রতিকার হিসাবে বেনজান ক্রোণিয়াম ক্লোরাইড (B.K.C.) ১-২ পি. পি. এম. হারে প্রয়োগ করতে হয় ।

    তথ্যসূত্র

    মৎস বিভাগ পশ্চিমবঙ্গ সরকার। 

    FAQ ( প্রায় জিজ্ঞাসিত প্রশ্নোত্তর )

    ১) গলদা চিংড়ি চেনার উপায় কি?

    গলদা চিংড়ি ক্রয় করার সময় চিংড়ির মাথা ভেঙ্গে দেখে নিতে হয়। চিংড়ির মাথা ভাঙার পর চিংড়ির মাথা ও দেহে উভয় অংশ চাপ দিলে জল বা জেলি ইনজেকশন দ্বারা পুশ করা হয়ে থাকলে জল বা পিচ্ছিল জেলি পদার্থ বেরিয়ে আসবে এছাড়াও চিংড়ি সতেজ রাখার জন্যে বিভিন্ন রাসায়নিক দ্রব্য চিংড়ির দেহে পুশ করা হয় । চিংড়িতে পুশকৃত অপদ্রব্যগুলি মেশানো চিংড়ি খেলে লিভার, কিডনি ড্যামেজ হয়ে যেতে পারে ধীরে ধীরে সেটি মেডিক্যাল সাইন্স মনে করে । এই সব অপদ্রব্য মেশানো স্বাস্থ্যের জন্য খুবই ক্ষতিকর চিংড়ি ক্রয় করার পূর্বে যাচাই করে নেওয়ার পরামর্শ দিয়ে থাকেন খাদ্য সুরক্ষা বিভাগ গুলি। 

    ২) গলদা চিংড়ির বৈশিষ্ট্য কি ?

    গলদা চিংড়ি  কঠিন খোলসে মোড়ানো মোটা মাথাবিশিষ্ট এক ধরনের সন্ধিপদী (আর্থ্রোপোডা) চিংড়ির গোত্রবিশেষ সামুদ্রিক প্রাণী।

    ৩) গলদা চিংড়ির পোনা কোথায় পাওয়া যাবে ?

    গলদা চিংড়ি চাষের জন্যে চিংড়ির পোনা গুলি মূলত সমুদ্র নিকটবর্তী চিংড়ি ভেরি গুলিতে পাওয়া যায়। এছাড়াও বেসরকারি ও সরকারি মৎস হ্যাচারি গুলিতে পাওয়া যায়। তবে চিংড়ি চাষের জন্যে চিংড়ি পোনা ক্রয়ের পূর্বে সরকার নির্ধারিত রেজিস্টার্ড প্রাপ্ত হ্যাচারি গুলি থেকে ক্রয় করা উচিত। এতে গুণগতমান সম্পূর্ণ চিংড়ি পোনা পাওয়া যায় যা চাষে কাঙ্খিত অর্থ উপার্জনে সহায়তা করবে। 

    একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

    0মন্তব্যসমূহ

    একটি মন্তব্য পোস্ট করুন (0)