মাছের বীজ পোনা পরিবহন আধুনিক কৌশল

Didibhai Agrofarm
0

মাছের বীজ পোনা পরিবহন আধুনিক কৌশল ২০২৩


মাছের ডিম পোনার প্রাকৃতিক উৎসস্থল হল নদী এবং কৃত্রিম প্রজননের উৎসস্থল হল বাঁধ ও হ্যাচারী। এদের চাহিদা দেশের সর্বত্র । তাই মাছের বীজ উৎসস্থল থেকে দেশের বিভিন্ন জায়গায় পরিবহণ করা মাছ চাষীদের কাছে একটি সমস্যা। এই সমস্যা সমাধানের জন্য নিম্নলিখিত দুটো পদ্ধতির মাধ্যমে ডিমপোনা পরিবহন করা হয়-

    ক) অ্যালুমিনিয়াম হাঁড়িতে ডিমপোনা পরিবহণ -

    হাঁড়িতে ডিমপোনা পরিবহণ একটি গতানুগতিক পদ্ধতি। এই পদ্ধতিতে ডিমপোনা বড় অ্যালুমিনিয়ামের হাঁড়িতে  সাইকেলে, ভ্যান রিক্সা,টোটো , বাস, লরী এবং ট্রেনে করে বিভিন্ন জায়গায় সরবরাহ করা হয়। একটি হাঁড়িতে কত সংখ্যাক ডিমপোনা পরিবহণ করা যাবে তা নির্ভর করে হাঁড়ির সাইজ এবং তার মধ্যে থাকা জলের পরিমাণের উপর। সাধারণতঃ ৩০-৩৫ লিটার জল ধরে এমন হাঁড়িতে প্রায় ৫০ হাজার থেকে ৬০ হাজার ডিমপোনা পরিবহণ করা যেতে পারে। যে হাঁড়িতে ডিমপোনা পরিবহণ করা হবে সেই হাঁড়িতে ডিমপোনা সংগ্রহের স্থানের জল অর্ধেক বা তার চেয়ে বেশী ভর্তি করে এলাকা ভেদে ৫০-৬০ গ্রাম লাল মাটি মিশিয়ে ডিমপোনা পরিবহণ করা হয়। 

    হাঁড়ির মুখে একটা গামছা থাকে এবং এই গামছার মধ্যে দিয়ে হাত ঢুকিয়ে জলকে নাড়াতে হয়, যাতে জলের সঙ্গে অক্সিজেন মিশতে পারে। মাঝে মাঝে হাঁড়ির জল ও মাটি পাল্টাতে হয়। কোন কারণে মরা মাছ ভেসে উঠলে বুঝতে হবে জলে অক্সিজেনের পরিমাণ কমে গেছে। তখন খুব তাড়াতাড়ি মরা মাছ ফেলে দিয়ে হাঁড়ির জল পাল্টে দিতে হয়। এইভাবে হাঁড়িতে করে ডিমপোনা পরিবহন উন্মুক্ত পদ্ধতি বলে। 
    তবে এই পদ্ধতিতে ডিমপোনা পরিবহনের ক্ষেত্রে মাছ চাষীরা কিছু সমস্যার সম্মুখীন হয় সেই  সমস্যাগুলো হল-

    ১) ডিম্ পোনা  বা ধনী  পোনা পরিবহণের সময় জলে থাকা  অক্সিজেন দ্রুত কমে আসে। তাই মাঝে মাঝে জল বদলাতে হয়।
     ২) জলে কার্বন-ডাই-অক্সাইডের পরিমাণ বাড়তে থাকে এবং এর ফলে  জলের PH  মাত্রা কমে গিয়ে জলে অস্বস্তিকর পরিবেশ তৈরী হয় যা ডিমপোনা পরিবহনের জন্যে ক্ষতিকর ।
    ৩) হাঁড়ির মধ্যে অত্যাধিক ডিমপোনা মজুত করে পরিবহন করলে  ডিমপোনা নষ্ট হয়ে অতিরিক্ত অ্যামোনিয়া গ্যাস এর  সৃষ্টি হয়, এর ফলে জলের মধ্যে জীবাণুর সংখ্যা বৃদ্ধি পায় যা ডিমপোনার ক্ষতি করে এবং অনেক ক্ষেত্রে নষ্ট হয়ে যায় ।
    ৪) পরিবহণকালে হাঁড়ির সঙ্গে ঘর্ষণের ফলে ডিমপোনার ক্ষতি হয়।
    হাড়িতে পরিবহন করলে এই সব সমস্যা সৃষ্টিকারী  রাসায়নিক পরিবর্তনের ফলে ডিমপোনা গুলি অল্প সময়ে নিস্তেজ হয়ে হাড়ির ২৫-৩০ ভাগ ডিমপোনা মারা যাওয়ার সম্ভবনা থাকে যা চাষীর জন্যে শুরুতেই একটি ধাক্কা বলা যায় ।

    খ) অক্সিজেন যুক্ত জলপূর্ণ পলিথিন ব্যাগে ডিমপোনা পরিবহণ -

    বর্তমানে ডিমপোনা পরিবহণ অর্ধেক জল ভর্তি পলিথিন ব্যাগে অক্সিজেনপূর্ণ একটা সাধারণ টিনের মধ্যে ভরে নিয়ে বাসে, ট্রেনে এমনকি বিমান পথেও দেশের বিভিন্ন প্রান্তে সরবরাহ করা হয়। এই পদ্ধতিকে বদ্ধ পদ্ধতি বলে। এই পদ্ধতির মাধ্যমে ডিমপোনা এবং ধানীপোনাও পরিবহণ করা যায়। পদ্ধতিটি হল -
    ১) একটি বিশেষ ধরনের পলিথিন ব্যাগ ব্যবহার করা হয় (০.০৬ মিমি পুরু এবং ৮২ সেমি দৈর্ঘ ও ৬০ সেমি প্রস্থ বিশিষ্ঠ)। এই ব্যাগটির ১/৩  অংশ থেকে ১/২ অংশ পরিস্কার জলে ভর্তি করা হয়।
    ২) একটি ১৫-১৬ কেজি তরল পদার্থ ধরে এরকম খালি টিনের মধ্যে জলপূর্ণ পলিথিন ব্যাগটিকে বসানো হয়। টিনের ঘর্ষনে যাতে পলিথিন ব্যাগের ক্ষতি না হয় সেজন্য টিনের ভিতরে কাগজ বসিয়ে তারপরে পলিথিন ব্যাগ রাখা হয়।
    ৩) সাধারণতঃ প্রতি ব্যাগে ২৫০০০ মত ডিমপোনা ভর্তি করা হয়। ধানীপোনার ১৫-২০ মিমি দৈর্ঘ্যর  ক্ষেত্রে এই সংখ্যা ১২০০-২০০০ পোনা পর্যন্ত নেওয়া যায় এর বেশি নয়। 
    ৪) জল ভরা পলিথিন ব্যাগ ও ডিমপোনা কিংবা ধানী পোনা টিনের মধ্যে বসিয়ে হাত দিয়ে পলিথিন ব্যাগে চাপ দেওয়া হয়, যাতে ব্যাগের ভিতরকার বাতাস বের হয়ে যায়।
    ৫) পলিথিন ব্যাগের চওড়া মুখ একত্রে একটু ফাঁক করে ধরে অক্সিজেন সিলিন্ডারের চাবি খুলে সরু রবার টিউবের মধ্যে দিয়ে ব্যাগে অক্সিজেন ভর্তি করা হয়। ব্যাগের শূন্যস্থান আস্তে সাস্তে অক্সিজেনের চাপে ফুলে ওঠে। যতটা অক্সিজেন ব্যাগে ভরা সম্ভব তা করবার পর রবার ব্যান্ড দিয়ে ব্যাগের মুখটিকে ভালোভাবে বেঁধে দেওয়া হয়, যাতে অক্সিজেন মুখ দিয়ে না বেরিয়ে যায়। এবার টিনের আধারের ঢাকনা বন্ধ করে প্যাকিং শেষ করা হয়।
    এই পদ্ধতিতে ডিমপোনা বা ধানীপোনার মৃত্যুর হার অনেক কম হয় এবং পরিবহণকালে একবারও জল পাল্টাতে হয় না। সাধারণতঃ ২৪ ঘন্টার মত সময়ে এই ব্যবস্থায় পরিবহণে মাছের পোনার ক্ষতি হওয়ার আশঙ্কা খুবই কম।

    গ। মাছ পরিবহণে ব্যবহৃত কিছু রাসায়নিক পদার্থ

    মাছকে যখন কোন পাত্রে জলবন্দি করে এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় পরিবহণ করা হয় তখন তাদের বিপাকজাত বর্জ্যপদার্থগুলো ঐ জলে জমা থাকে। অ্যামোনিয়া, ইউরিয়া, ইউরিক অ্যাসিড, কার্বন- ডাই-অক্সাইড ইত্যাদি হল প্রধান বিপাকজাত পদার্থ এবং এর প্রতিটিই ক্ষতিকর। লক্ষ্য করা গেছে যে জলে ১ পি.পি.এম. অ্যামোনিয়ার ঘনত্ব বাড়লে রক্তে অক্সিজেনের পরিমাণ স্বাভাবিক অবস্থার চেয়ে ১/৭ অংশ কমে যায়। শুধু অক্সিজেনই নয়, কার্বন-ডাই-অক্সাইডের ঘনত্বও শতকরা ১৫ ভাগ বেড়ে যায় ফলে যার ফলে মাছের শ্বাসকষ্ট  হয়।
    তাই মাছ পরিবহণে hypnotic / tranquiliser drug (যেমন সোডিয়াম অ্যামাইটাল ইত্যাদি) ব্যবহার করার ফলে মাছের দেহের শারীরবৃত্তীয় কার্যকলাপ ও বিপাক হার কমে যায়। এর ফলে জলপূর্ন পরিবহণ পাত্রে বিপাকজাত বর্জ্যপদার্থের পরিমাণও কমে যায় এবং মাছের শ্বাসকষ্ট কম হয়।
    মৎস্য দপ্তরের ক্যাপ্টেন ভেড়ী গবেষণকেন্দ্রে পরীক্ষায় দেখা গেছে পরিবহণের সময় ৫ পি.পি. এম. হারে Diazepam গ্রুপের ওষধ যেমন ভ্যালিয়াম (Vallium) ব্যবহার করে ভাল ফল পাওয়া যায়।

    ঘ। মাছের বীজ বা পোনা  পুকুরে / ট্যাঙ্কে ছাড়ার কৌশল -

    পরিবহন করে আনার পর সঙ্গে সঙ্গে পুকুর বা ট্যাঙ্কের জলে ছাড়া হয় না তার কারণ পরিবহন এর সময়ে যে জল ব্যবহার হয় সেই জলের তাপমাত্রা বেড়ে যায় পুকুর বা ট্যাঙ্কের জলের তুলনায় ফলে সেই অবস্থায় জলে সরাসরি ছেড়ে দিলে অনেক মাছ পুকুরের তলে গিয়ে মারা যায়। তাই যে পাত্রে পরিবহন করা হয় সেই পাত্রটি পুকুর বা ট্যাঙ্কের জলে ভাসিয়ে রাখা হয়। হাড়ি হলে ১৫-২০ মিনিট রাখা হয় এবং জল নাড়ানো হয় অক্সিজেন এর ঘাটতি না হওয়ার জন্যে কিন্তু অক্সিজেন প্যাকেট করে পোনা পরিবহন হলে ৩০ মিনিট ১ ঘন্টা রাখলেও অসুবিধে হয় না। 
    তাপমাত্রা সমান হয়ে গেলে পোনা বা চারা মাছ  একটি পাত্রে জল নেওয়া হয় এবং প্রতি লিটার জলে ১ মিলিগ্রাম পটাসিয়াম পারমেঙ্গানেট অথবা ২০ গ্রাম লবন গুলিয়ে সেই জলে পোনা গুলি ৩০ সেকেন্ড একটি নেটে নিয়ে ভিজিয়ে রেখে পুকুর বা ট্যাঙ্কের জলে ছাড়া হয়। 

    FAQ -

    ১। অক্সিজেন দিয়ে পলিথিন ব্যাগে কত গুলি বীজ পোনা পরিবহন করা যায় ?

    প্রতি ব্যাগে ২৫০০০ মত ডিমপোনা ভর্তি করা হয়। ধানীপোনার ১৫-২০ মিমি দৈর্ঘ্যর  ক্ষেত্রে এই সংখ্যা ১২০০-২০০০ পোনা পর্যন্ত নেওয়া যায় এর বেশি নয়। 

    ২। বীজপনা পরিবহনের  অক্সিজেন পলিথিন ব্যাগের সাইজ কি হয় ?

    বিশেষ ধরনের পলিথিন ব্যাগ ব্যবহার করা হয় (০.০৬ মিমি পুরু এবং ৮২ সেমি দৈর্ঘ ও ৬০ সেমি প্রস্থ বিশিষ্ঠ)। এই ব্যাগটির ১/৩  অংশ থেকে ১/২ অংশ পরিস্কার জলে ভর্তি করা হয়।

    ৩। পাত্রে  বীজ পোনা পরিবহনে কোন রাসায়নিক পদার্থ ব্যবহার করা হয় ?

    এক জায়গা থেকে আর এক জায়গায় জল ভর্তি পাত্রে মাছ পরিবহণে hypnotic / tranquiliser drug (যেমন সোডিয়াম অ্যামাইটাল ইত্যাদি) ব্যবহার করার ফলে মাছের দেহের শারীরবৃত্তীয় কার্যকলাপ ও বিপাক হার কমে যায়। এর ফলে জলপূর্ন পরিবহণ পাত্রে বিপাকজাত বর্জ্যপদার্থের পরিমাণও কমে যায় এবং মাছের শ্বাসকষ্ট কম হয়।মাছের অক্সিজেন পরিমান ঠিক থাকে ও কার্বনডাই অক্সাইড এর পরিমান বাড়ে না। 

    তথ্য সূত্র -   

    মৎস পালন বিভাগ পশ্চিমবঙ্গ সরকার। 

    আরও দেখুন -

    একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

    0মন্তব্যসমূহ

    একটি মন্তব্য পোস্ট করুন (0)