কার্প ফিশ/মাছ ফ্যাটেনিং কৌশল

Didibhai Agrofarm
0

 কার্প ফিশ/মাছ ফ্যাটেনিং কৌশল

দ্বিতীয় আহরণ শতকে ৮ টি তে যখন ৪০ কেজি হবে এবং বাকি গুলো শেষ আহরণে শতকে ৪০ কেজির উর্ধে হলে তুলে ফেলতে হবে। সব কিছু ঠিক থাকলে ১ কেজি ওজনের মাছ পুকুরে ছাড়লে ১ বিঘা পুকুরে ১৮ মাসে মোট মাছের  উৎপাদন ২২ কুইন্টাল পাওয়া যাবে।


বর্তমান সময়ে খাদ্যের অপচয় রোধ করে কম খরচে বড় মাছ উৎপাদন করে বেশি দামে বিক্রি করে মাছ চাষ করে অধিক লাভের দিশা দেখাচ্ছে মৎস গবেষকরা। মাছের সাইজ বড় করা বা মোটাতাজা করন করতে হলে কয়েকটি বিষয় উল্লেখ যোগ্য ভূমিকা রাখে এবং সেগুলি যথাযথভাবে পালন করলে কম খরচে অধিক লাভ আশা করা যায় মৎস গবেষকরা জানিয়েছেন। 

    ফিশ ফ্যাটেনিং বা মোটাতাজাকরণ করতে হলে যে বিষয় গুলি প্রথম জানা দরকার সেগুলি হল -

    ১। পুকুর নির্বাচন ,

    ২। পুকুর প্রস্তুতি ,

    ৩। পুকুরে পোনা মজুত 

    ৪। পুকুরের যত্ন বা পরিচর্যা ,

    এই বিষয় নিচে বিস্তারিত ভাবে আলোচনা করা হল -

    ১।  পুকুর নির্বাচন-

    • যে সব পুকুর সারা বছর জল থাকে ৪.৫ -৬ ফুট। পুকুরের পাড় উঁচু বর্ষায় সহজে প্লাবিত হবে না। 
    • পুকুরের মাটি এঁটেল দোআঁশ এবং পাক বা কাদা কম সেই সব পুকুর এই চাষের জন্যে বেঁছে নেওয়া উচিত। 
    • পুকুর আয়তাকার ও আয়তনে ১ বিঘার থেকে বড় ৬০ ডিগ্রি কোণে ঢাল আছে ও বর্ষায় ৮ থেকে ১০ ফুট জল থাকে এক একরের বেশি হলে ভাল। 
    • পুকুরের জলে বিনা বাধায় যেন সূর্যালোক পড়তে পারে এমন ব্যবস্থা থাকা ভালো। তবে নারকেল সুপারি এই জাতীয় গাছ থাকলে অসুবিধে নেই। 

    ২।  পুকুর প্রস্তুতি -

    মাছ চাষের জন্যে পোনা মজুতের পূর্বে  পুকুর প্রস্তুতি একটি গুরুত্ব পূর্ণ ভূমিকা রাখে। যে বিষয়গুলি সঠিক ভাবে পালনের ক্ষেত্রে অনেক কৃষক বন্ধু ভুল করে। যেমন -

    ক। পুকুরে উপস্থিত অপ্রয়োজনীয় বস্তুর দমন,

    খ। চুন প্রয়োগ ,

    গ। জলে খাদ্য তৈরী। 

    উপরোক্ত বিষয় তিনটি নিন্মে বিস্তারিত ভাবে আলোচনা হল -

    ক। পুকুরে উপস্থিত অপ্রয়োজনীয় বস্তুর দমন--

    • পুকুরের আগাছা পরিষ্কার করে ফেলতে হবে। গ্রাসকার্প খাদ্য এমন কিছু আগাছা রাখা যেতে পারে। 
    • পুকুরের পাড় মেরামত করতে হবে। যে কোনো খাল বন্ধ রাখতে হবে। অতিরিক্ত জল বাইরে বের করার ব্যবস্থা রাখতে হবে কিন্তু সেটি দিয়ে যেন বাইরের জল ভেতরে প্রবেশ না করে সেভাবে ব্যবস্থা করতে হবে। অবাঞ্চিত মাছ তুলে ফেলতে হবে। 
    • মাছ নিধনের জন্যে ২৫ পি পি এম হারে ৩ ফুট জলের গভীরতায় প্রতি শতকে ৯  কেজি মহুয়া খৈল ব্যবহার করা যেতে পারে অথবা একই জলের গভীরতায় শতকে তিনটি গ্যাস ট্যাবলেট দেওয়া যেতে পারে। 

    খ। চুন প্রয়োগ-

    মহুয়া খৈল বা গ্যাস  ট্যাবলেট ব্যবহারের ৭ দিন পর ৩ ফুট জলের গভীরতায়  প্রতি শতক জলে ১-১.৫ কেজি পাথরে  চুন দিতে হবে। কাদা বেশি থাকলে শতকে ২ কেজি চুন দিয়ে ঘেটে দিতে হবে। পুকুরে ৬ ফুট জল হলে শতকে ৩-৪ কেজি চুন দিতে হবে। 


    আরও দেখুন -মাছ চাষে পুকুরে চুন প্রয়োগের সঠিক পদ্ধতি ? কোন চুন কিভাবে কখন কতটা ব্যাবহার করলে মাছের ওজন ভাল হবে?

    গ। জলে খাদ্য তৈরী-

    মাছ চাষ করার জন্যে পুকুরে জৈব ও অজৈব খাদ্য মজুত করা আবশ্যক। জলে খাদ্য পুকুরে প্রাণী কণা,ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র প্রাণী ,কেঁচো ইত্যাদি তৈরী করে এর জন্যে দুটি ভাবে জৈব সার প্রয়োগ করা হয় , পুকুরে গোবর সার প্রয়োগ করা হয় যা পুকুরের তলায় গিয়ে মুজুত হয় এবং  জলে যে খাদ্য তৈরী হয় তাকে বলে জু প্ল্যাঙ্কটন বা প্রাণী কণা যার রং বাদামি হয় জল এর জন্যে নিয়মিত খাদ্য ব্যবহার করতে হয় । অজৈব সার সাধারণত রাসায়নিক সার ব্যবহার করে করা হয় এতে জলে উদ্ভিদ কণা বা ফাইটো প্ল্যাঙ্কটন  যার রং জল সবুজ হয় । 

    সার প্রয়োগ তিনটি ভাবে হয় যেমন -

    ১। গোবর বা কম্পোস্ট সার প্রয়োগ ,

    ২। জু প্ল্যাঙ্কটন ,

    ৩। ফাইটো প্ল্যাঙ্কট,

    ব্যবহারের নিয়ম বিস্তারিত জানা যাক -

    ১। গোবর বা কম্পোস্ট সার প্রয়োগ -

    মহুয়া খৈল ব্যবহার করলে চুন দেওয়ার ৩ দিন পর প্রতি শতকে ১৫ কেজি গোবর বা কম্পোস্ট সার এবং মহুয়া খৈল ব্যবহার না করলে শতকে ৩০ কেজি  গোবর বা কম্পোস্ট সার  দিতে হবে। 

    ২। জু প্ল্যাঙ্কটন-

    জু প্ল্যাঙ্কটন হল জৈব খাদ্য যা প্রয়োগ করলে পুকুরের জল হালকা বাদামি রং ধারণ করে এবং প্রাণী কনার সৃষ্টি করে।  যদি গোবর সার ছড়িয়ে দেওয়ার পর জলের রং না পরিবর্তন হয় তবে নতুন করে খাদ্য তৈরী করে দিতে হবে। এই খাদ্য গুলি নিয়মিত মাসে প্রয়োগ করতে হয়। এই খাদ্য তৈরির জন্যে প্রতি শতকে ৬০০ গ্রাম কাঁচা গোবর ,১৫০ গ্রাম সর্ষের খৈল একত্রে ৫  দিন পচিয়ে দেওয়া দিতে হয় । এতে পর্যাপ্ত প্রাণী কণা তৈরী হবে। 

    ৩। ফাইটো প্ল্যাঙ্কটন -

     এটি হল একটি অজৈব উপাদান দিয়ে তৈরী জলজ প্রাকৃতিক খাদ্য। এই খাদ্য প্রয়োগ করলে জল স্বচ্ছ সবুজ হয়। উদ্ভিদ কণা তৈরী করে যা মাছের পর্যাপ্ত খাদ্য হয় এবং সূর্যালোকে সালোকসংলেস ঘটিয়ে অক্সিজেন তৈরী হয় পুকুরে। 

    এই খাদ্য তৈরীর জন্যে প্রতি শতকে DAP ১০০ গ্রাম ইউরিয়া ৫০ গ্রাম অথবা ফসফেট ১০০ -১৫০  গ্রাম ইউরিয়া ১০০-১৫০ গ্রাম ও ১০ গ্রাম পটাশ মিশিয়ে জলে গুলে পুকুরে ছড়িয়ে দিতে হবে।  এক্ষেত্রে মনে রাখতে হবে DAP ও ফসফেট জলে গুলতে সময় লাগে তাই দুটি ক্ষেত্রেই আগে এগুলি ২-৩ ঘন্টা ভিজিয়ে নিয়ে পরে  প্রয়োগ করার ৩০ মিনিট আগে ইউরিয়া মিশিয়ে দিয়ে প্রয়োগ করতে হবে। জলে তিন চারদিন পর রং চলে আসবে এবং ৭ দিন পর  পোনা ছাড়ার উপযুক্ত হবে। 


    আরও দেখুন -মাছ চাষে পি এইচ (PH ) এর গুরুত্ব। জলে Ph এর গুরুত্ব ও ব্যবহার -

    ৩। পুকুরে পোনা মজুত -

    ফিশ ফ্যাটেনিং বা মাছের মোটা তাজা করণের জন্যে পোনার সংখ্যা নির্ধারণ মাছ চাষে সাফল্য এনে দিতে পারে এবং দিচ্ছে। এই পদ্ধতি গ্রহণ করতে হলে পোনা ছাড়ার জন্যে কয়েকটি  বিষয় জানা জরুরি -

    ক। পুকুরের স্তর  ,

    খ। পোনার  সাইজ নির্ণয় ,

    গ। শতকে পোনার সংখ্যা ,

    ঘ। মাছের উৎপাদন ,

    উপরোক্ত চারটি বিষয় ভালো করে বুঝে নিয়ে ফ্যাটেনিং প্রযুক্তিতে মাছ চাষের সিদ্ধান্ত নেওয়া উচিত বলে মৎস বিশেষজ্ঞরা মনে করেন। নিন্মে আলোচিত হল -

    ক। পুকুরের স্তর -

    মাছ ছাড়ার পূর্বে জেনে নিতে হবে কোন কোন মাছ কিভাবে পুকুরে বসবাস করে এবং আহার গ্রহণ করে। মাছ মূলত পুকুরে ৩ টি স্তরে প্রজাতি ভেদে বসবাস করে ও খাদ্য গ্রহণ করে। 

    পুকুরের উপরের স্তর -

    এই স্তরে মূলত সেই সব মাছ বসবাস করে যাদের নিচের ঠোঁট বড় এবং উপরের ঠোঁট ছোট। যেমন কাতল , সিলভার কার্প ,বিগহেড। এরা মূলত উপরের স্তরের খাওয়ার খায় যেমন  সিলভার কার্প মূলত উদ্ভিদ কণা খায়। 

    পুকুরের মধ্যম স্তর -

    এই স্তরে যে সব মাছ বসবাস করে তাদের দুটি ঠোঁট প্রায় একই সমানের হয় যেমন -রুই ,গ্রাস কার্প ,পুটি ইত্যাদি। রুই মূলত প্রাণী কণা খায় এবং গ্রাস কার্প তার দৈহিক ওজনের সমপরিমাণ খাদ্য খায় যেমন পুকুর পারে কলমি ,হেলেঞ্চা জাতীয় ঘাস ,এছাড়াও উপর থেকে ঘাস দেওয়া যেতে পারে। 

    পুকুরের তলার স্তর - 

    এই স্তরে যে মাছ গুলি থাকে তাদের উপরের ঠোঁট বড় হয় এবং নিচের ঠোঁট ছোট হয় যেমন মৃগেল ,সারপ্রিনারস মাছ। এরা মূলত তলাবাসী মাছ নিচে জমে থাকা খাদ্য ,ছোট প্রাণী ইত্যাদি খায়। 

    আরও দেখুন -পুকুরে মাছ ভাসার সম্ভাব্য কারন কি? এবং করনীয় কি ?

    খ। পোনার  সাইজ নির্ণয় -

    ফিশ ফ্যাটেনিং বা মোটাতাজা করন এর জন্যে পোনার সাইজ একটি গুরত্ব পূর্ণ ভুমিকা রাখে। পোনা হিসেবে যতবড় মাছ ছাড়া যাবে তাতে বেশি ওজনের মাছ দ্রুত উৎপাদন করা যাবে। তার আগে জানতে হবে যে সঠিক পরিমানে খাদ্য পেলে একটি মাছ প্রতিদিন গড়ে তার দৈহিক ওজনের কত% বাড়ে তাহলেই বুঝা যাবে যে বড় সাইজের মাছ ছাড়ার কারণ কি ? মাছ দৈনিক তার দেহ ওজনের ২% থেকে ৩% বৃদ্ধি হয় এবং গড় হিসেবে করলে ৩% দৈনিক বৃদ্ধি হয় তবে বড় মাছের ক্ষেত্রে বৃদ্ধির হার একটু কম থাকে কিন্তু খাদ্য চাহিদাও কম থাকে । সুতরাং একটি ১০০ গ্রাম মাছের দৈনিক বৃদ্ধি ৩ গ্রাম এবং মাসে বৃদ্ধি হয় ৯০ গ্রাম আবার ওই একই সময়ে একটি ১ কেজি ওজনের মাছ তার দৈহিক ওজনের 2% বৃদ্ধি মানে 20 গ্রাম বৃদ্ধি হয় দৈনিক এবং মাসে ৬০০ গ্রাম বৃদ্ধি হয়। 

     সঠিক সাইজ ও সংখ্যা নির্ধারণ করে দিলে ও খাদ্য ও জলের পরিবেশ ঠিক রাখতে পারলে কাঙ্খিত ওজনের মাছ পাওয়া যাবে। তবে এই বৃদ্ধি মাছের নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে হয়। অর্থাৎ মাছ ছোট থাকতে তার বৃদ্ধির চাহিদা বেশি তার পর ধীরে ধীরে  কমতে থাকে তাই তাদের দৈহিক ওজনের তুলনায় খাদ্য চাহিদা কমতে থাকে এবং এক সময়ে দৈহিক  বৃদ্ধির হার ০.০৫% হয় ।  আশা করা যাচ্ছে এ থেকে বুঝা গেলো যে ভালো জাতের ও বড় সাইজের পোনা ছাড়লে দ্রুত বৃদ্ধি হবে এবং বড় মাছের বাজার মূল্য দ্বিগুন পাওয়া যাবে। প্রতি শতকে ৫০০ গ্রাম এর উর্ধে ১ থেকে ১.৫  কেজি পর্যন্ত  এমন একই সাইজের মাছ পোনা হিসেবে পুকুরে ছাড়তে হবে এতে বৃদ্ধি কমতে থাকলেও কম খাদ্যে মোট ওজনের বেশি বৃদ্ধি হয় ছোট মাছের তুলনায় । 

    তবে পুকুরে ছাড়ার পূর্বে পোনাগুলি প্রতি লিটার জলে ১ এম এল পটাসিয়াম পারমেঙ্গানেট বা 20 গ্রাম লবন গুলিয়ে সেই জলে স্নান করিয়ে ছাড়লে রোগ আক্রমণ হওয়ার সম্ভাবনা থাকবে না পোনা আহরণের সময় যদি কোনো ক্ষত হয় তার থেকে রোগ সৃষ্টি হয় না। 

    গ। শতকে পোনার সংখ্যা -

    পুকুরে পোনা মজুত এর আগে জানতে হবে প্রতি শতকে বা বিঘাতে মাছের ধারণ ক্ষমতা কত ? মাছ বৃদ্ধির একটি সময় আর মাছ না বাড়ার কারণ কি ?

    যে কোনো জায়গার একটি ধারণ ক্ষমতা থাকে। পুকুরেও একটি ধারণ ক্ষমতা আছে যার পরে পুকুরের জলের  অস্বাস্থকর হয়ে যায় এবং মাছের বৃদ্ধি ব্যাহত যদি আধুনিক পন্থা হিসাবে এরিয়েটর ব্যবহার করা হয় তবে ধারণ ক্ষমতা বৃদ্ধি হয় ও এমোনিয়াকে ভেঙে দেওয়ার জন্যে কার্বন সোর্স হিসাবে মোলাসেস বা চিটা গুড় এর ব্যবহার হয় । 

    এর কারণ পুকুরে পর্যাপ্ত পরিমানে অক্সিজেন মাছের প্রয়োজন হয় যখন পর্যাপ্ত অক্সিজেন ব্যাহত হয় তখন মাছের বৃদ্ধি কমে যায়, এটির কারণ পুকুরে মাছ খাদ্য গ্রহণ করে মলত্যাগ করে এবং অপচয় খাদ্য জমা হয়ে কার্বনডাই অক্সাইড তৈরী হয় দ্বিতীয়ত মাছ অক্সিজেন গ্রহণ করে কার্বন ডাই অক্সাইড ত্যাগ করে ফলে এক দিকে যেমন মাছের অক্সিজেন চাহিদা বাড়তে থাকে অপরদিকে কার্বনডাই অক্সাইড দ্বিগুন মাত্রায় বাড়তে থাকে ফলে মাছের বৃদ্ধি ব্যাহত হয়।  অনেক রোগ হয় হঠাৎ করে ভেসে উঠে মারা যায়। খাদ্য চাহিদা বাড়ে সেই খাদ্য চাহিদা পূরণ করতে গিয়ে অপচয় খাওয়ার জলে কার্বনডাই অক্সাইড তৈরী হয়।  তাই আমাদের জানা উচিত আগে কতটা পরিমান  মাছ ধারণ করে পুকুরে। 

    এবার জানা যাক কি কি মাছ প্রতি শতকে তার সংখ্যা কত হবে। কাতলা ১ টি ,সিল্ভারকার্প ১ টি ,বিগহেড ১ টি এগুলি উপরের স্তরের। রুই ৩ টি ,গ্রাসকার্প ১ টি এগুলি মধ্যম স্তরের। মৃগেল ৪ টি ,সরপ্রিনার্স ১ টি এগুলি নিচের স্তরের। প্রতি শতকে ১২ টি এবং বিঘা প্রতি ৩৯৬ টি মাছ ছাড়া হয়। 

    ফিশ ফ্যাটেনিং করার জন্যে মাছ পালন করতে হলে পোনার সংখ্যা ও সাইজ নির্ধারণের প্রতি দৃঢ় প্রতিজ্ঞ হতে হবে। সংখ্যা বা সাইজ নির্ধারণের প্রতি সচেতনতা বজায় রাখতে হবে ,আবেগের বসে বেশি সংখ্যা ও ছোট পোনা ছাড়া যাবে না। 

    ঘ। মাছের উৎপাদন-

    মাছ ফ্যাটেনিং বা মোটাতাজকরণ উৎপাদন প্রক্রিয়া ১৫ -১৮ মাস পর্যন্ত করা চালিয়ে যাওয়া হয়। মাঝে আংশিক আহরণ করে যেগুলোর বৃদ্ধি কম স্তর ভিত্তিতে কমিয়ে দিয়ে শেষের মাঝ গুলি ৩-৪ টি মাছে ৩৫-৪০ কেজি শতকে উৎপাদন করা যায়। শতকে ১২ টি মাছে যখন ৪০ কেজি হবে তখন প্রথম মাছ আহরণ করা হয় যে মাছ গুলির বৃদ্ধি আশানু রূপ মনে হবে না। 

    এর পর দ্বিতীয় আহরণ শতকে ৮ টি তে যখন ৪০ কেজি হবে এবং বাকি গুলো শেষ আহরণে শতকে ৪০ কেজির উর্ধে হলে তুলে ফেলতে হবে। সব কিছু ঠিক থাকলে ১ কেজি ওজনের মাছ পুকুরে ছাড়লে ১ বিঘা পুকুরে ১৮ মাসে মোট মাছের  উৎপাদন ২২ কুইন্টাল এর অধিক পাওয়া যায় । 


    আরও দেখুন -হাইব্রিড তেলাপিয়া মাছ চাষ

    ৪। পুকুরের যত্ন বা পরিচর্যা-

     ক। হাতে তৈরী খাদ্য দিলে প্রতিদিন নির্দিষ্ট সময়ে  দু বেলা পুকুরে  হাতে তৈরী খাদ্য দিতে হবে। পুকুরে মজুত ১ টি পোনার দৈহিক ওজন যদি ৫০০ গ্রাম থেকে ৮০০ গ্রাম হয় তবে তার দৈহিক ওজনের ২%-১.৫% খাদ্য দিতে হবে। আবার যদি ৮০০ গ্রাম এর বেশি হয় মাছের ওজন ,তবে  মাছের দৈহিক ওজন এর  ১% পরিমান খাদ্য দিতে হবে।  অর্থাৎ পুকুরে  মোট মাছের ওজন যদি 100 কেজি হয় তবে তার  ১% হলে ১ কেজি  খাদ্য দুবেলা ভাগ করে দিতে হবে। 

    খ। সরিষার খৈল ও রাইস ব্রান (রাইস ব্রান না পেলে চালের কুরো) সমপরিমাণ ১ :১ হারে মিশিয়ে দিতে হবে।  অর্থাৎ ১০ কেজি খাদ্য তৈরী করলে ৫ কেজি সরিষার খৈল+রাইস ব্রান ৫ কেজি + ডি.ও .আর .বি মোট খাদ্যের ০.০২৫ % লবন ১০০ গ্রাম দিয়ে খাদ্য তৈরী করে দিতে হবে এবং ডি.ও .আর .বি যুক্ত করতে হবে  অথবা সরিষার খৈল, রাইস ব্রান বা চালের কুরো,খেসারি ভুসি শুটকি মাছের গুঁড়ো ,গমের ভুসি ১:১:১:১ হারে মিশিয়ে দেওয়া যেতে পারে। 

    গ। প্রথম ১ মাস সব কিছু ভালো করে গুঁড়ো করে ছেঁকে নিয়ে পুকুরে ছড়িয়ে দেওয়া যেতে পারে।  ১ মাস পর  প্রয়োগের জন্যে আগের দিন সরিষার খৈল ভিজিয়ে রাখতে হবে পরের দিন সরিষার খৈল+রাইস ব্রান+ লবন একত্রে মিশিয়ে  বড় বড়  বল বানিয়ে পুকুরের দু তিন জায়গায় বা এক একরের বেশি বড় পুকুর হলে ৪-৫  জায়গায় একটি বাসের ঝুড়িতে বা প্লাস্টিকের ঝুড়ি যুক্ত ট্রে তে বসিয়ে জলের নিচে বসিয়ে দিতে হবে রোজ নির্দিষ্ট সময়ে।   

    ঘ। গ্রাসকার্প মাছের জন্যে তার দৈহিক ওজনের সমপরিমাণ উদ্ভিদ খাদ্য দিতে হবে।  যদি মাছের ওজন ১ কেজি হয় তবে ১ কেজি খাদ্য নিশ্চিত করতে হবে।  খাদ্য হিসেবে ঘাস , এজলা ,কুটি পানা উপর থেকে দেওয়া যেতে পারে এবং পুকুরে কলমি ,হ্যালেঞ্চে শাক রাখতে হবে। 

    ঙ। পুকুরে মাসে একবার ৩ ফুট জলের গভীরতা প্রতি শতকে ২০০ গ্রাম এবং বিঘা প্রতি ৬.৫০০ গ্রাম  চুন ২৪ ঘন্টা ভিজিয়ে রেখে প্রয়োগ করতে হবে। সকাল ১০ টার পর রৌদ্রোজ্জ্বল আকাশে। মেঘলা আকাশ বা বৃষ্টি থাকলে প্রয়োগ থেকে বিরত থাকতে হবে। 

     চ।  প্রতি মাসে একবার ৩ ফুট জলের গভীরতা শতকে ১০০  গ্রাম এবং বিঘা প্রতি ৩ কেজি ৩০০ গ্রাম লবন জলে এক ঘন্টা ভিজিয়ে রেখে সমস্ত পুকুরে প্রয়োগ করতে হবে। এর ফলে তলায় রোগ জীবাণু কম কম জন্মাবে। মাছের ফুলকা পরিষ্কার থাকবে এবং মাছের রোগ কম হবে। এক ধরণের নিয়মিত চিকিৎসার মধ্যে মাছ থাকবে। 

    ছ। পুকুরে মাসে এক বার ৩ ফুট জলের গভীরতা প্রতি শতকে ৫০ গ্রাম মোলাসেস বা চিটে গুড় জলে গুলিয়ে সমস্ত পুকুরে ছড়িয়ে দিতে হবে। 

     জঁ। পুকুরে জলে খাদ্য উপস্থিতি বা সবুজ বাদামি জলের রং বজায় রাখতে হলে প্রতি মাসে একবার জৈব ও অজৈব সার প্রয়োগ করতে হবে চুন লবন প্রয়োগের ৩ দিন  পর। 


    আরও দেখুন -পুকুরের জল বাদামি রং ,সবুজ রং ,দুর্গন্ধ হয়ে যাওয়ার কারণ ও তার প্রতিকার পদ্ধতি -


    ঝ। ৩ ফুট জলের গভীরতা প্রতি শতকে ৬.৫০ গ্রাম গোবর ১.৫০ গ্রাম সরিষার খৈল বা বিঘা প্রতি ২০ কেজি গোবর ও ৫ কেজি সরিষার খৈল এর ৩-৪ গুন্ জলে  ৫ দিন ভিজিয়ে রেখে ৬ দিনের দিন সকাল ১০ টার পর প্রয়োগের দু ঘন্টা আগে আলাদা একটি পাত্রে অজৈব সার প্রতি শতকে ১.৫০ গ্রাম বা বিঘা প্রতি ৫  কেজি DAP এর ৩ গুন্ জল মিশিয়ে ভিজিয়ে রেখে জৈব ও অজৈব সার মিশিয়ে পুকরের চারি দিকে জলে ছড়িয়ে দিতে হবে। ৩ দিন পর জলের রং স্বচ্ছ বাদামি সবুজ দেখা যাবে । বৃষ্টি বা মেঘলা আকাশে প্রয়োগ করবেন না। 

    ঞ। ৩ ফুট জলের গভীরতা প্রতি শতকে ৪ কেজি শুকনো গোবর দিতে হবে।  এই জৈব ও অজৈব সার প্রয়োগের মধ্যে ১৫ দিন অন্তর রাখতে হবে। ১৫  দিন অন্তর জাল টানা উচিত হবে এতে মাছ সুস্থ সবল ও পুকুরের পরিবেশ ভালো থাকবে। 

    ট। যদি প্রথম পদ্ধতিতে জল সবুজ না হয় তবে প্রতি শতকে ৭৫ গ্রাম আটা এবং ৪ গ্রাম ইউরিয়া বা বিঘা প্রতি ২.৫০০ গ্রাম আটা এবং ১.২৫ গ্রাম ইউরিয়া জলে আধ ঘন্টা ভিজিয়ে নিয়ে প্রয়োগ করা যেতে পারে।       

    ঠ। প্রথম পদ্ধতিতে  যদি জলে বাদামি বা জু প্ল্যাঙ্কটন বা প্রাণী কণা তৈরী না হয় তবে প্রতি শতাংশের জন্যে  ২০০ গ্রাম রাইস ব্র্যান , রাইস ব্র্যান এর ১০ ভাগের ১ ভাগ ২০ গ্রাম মোলাসেস এবং রাইস ব্র্যান এর ২০০ ভাগের ১ ভাগ বা ১ গ্রাম ইস্ট একত্রে করে তার ৩-৪ গুন্ জল মিশিয়ে  ২৪ ঘন্টা ভিজিয়ে রেখে পরের দিন অন্য একটি পাত্রে ঢেলে প্রয়োজনীয় জল মিশিয়ে পুকুরে ছড়িয়ে দিতে হবে এবং ভিজিয়ে রাখা পাত্রে যেগুলি জমে থাকবে সেগুলিতে আবার জল ভোরে রেখে দিয়ে পরের দিন ছড়িয়ে দিলে পর্যাপ্ত কাজ হয়ে যাবে। 

    ড। এছাড়াও জু প্ল্যাঙ্কটন এর জন্যে যদি গোবর খৈল জল প্রয়োগ না করা হয় তবে প্রতি শতাংশে ৪০০ গ্রাম বা বিঘা প্রতি ১৩ কেজি ধানের  খড় পুকুরের সাইডে জলে   ভিজিয়ে রেখে ব্যবহার করলে ৪ ঘন্টা পর থেকে নির্যাস তৈরী হতে থাকে এবং জু ও ফাইটোপ্লাঙ্কটন পর্যাপ্ত পরিমানে পাওয়া যায়। 

    ঢ। গ্রাস কার্প মাছ থাকলে মাছের দৈহিক ওজন যা সেই পরিমান ঘাস বা জলজ আগাছা প্রতিদিন প্রয়োজন। যদি মাছের ওজন এক কেজি হয় তবে ১ কেজি পরিমানে দৈনিক খাদ্য গ্রাসকার্প মাছের প্রয়োজন এজন্যে আলাদা করে ঘাস কেটে কুটিপানা ,এজলা বা পারের দিকে পর্যাপ্ত কলমি শাক ,হেলেঞ্চা গাছের উপস্তিতি রাখতে হবে। 

    ণ। মাছ আহরণের পর চেষ্টা করতে হবে গাড়িতে জল নিয়ে তাজা মাছ বাজারে উপস্থিত করার এতে দাম বেশি পাওয়া যাবে। 

    আরও দেখুন-পাবদা মাছের চাষ ও প্রজনন

    তথ্য সূত্র -  

    ক। মৎস পালন বিভাগ পশ্চিমবঙ্গ সরকার। 

     খ। কাজী আবেদ লতীফ -  বাংলাদেশ উপজেলা মৎস বিভাগ প্রাক্তন আধিকারিক। 

    FAQ -

    ১। ফিশ ফ্যাটেনিং করতে মাছের সংখ্যা কত দেওয়া হয় ?

     কাতলা ১ টি ,সিল্ভারকার্প ১ টি ,বিগহেড ১ টি এগুলি উপরের স্তরের। রুই ৩ টি ,গ্রাসকার্প ১ টি এগুলি মধ্যম স্তরের। মৃগেল ৪ টি ,সরপ্রিনার্স ১ টি এগুলি নিচের স্তরের। প্রতি শতকে ১২ টি এবং বিঘা প্রতি ৩৯৬ টি মাছ ছাড়া হয়।

    ২। ফিশ ফ্যাটেনিং বা মোটাতাজা করন কতদিনের চাষ হয় ?

     ফিশ ফ্যাটেনিং বা মোটাতাজা করন  ১৪-১৮ মাস সময়ের চাষ হয় । 

    ৩। ফিশ ফ্যাটেনিং বা মাছের মোটাতাজা করন এর জন্যে কেমন পুকুর প্রয়োজন ?

    মাছের মোটাতাজা করন এর জন্যে পুকুর এক একরের বেশি এবং গভীরতা ৮-১০ ফুট ও জল সারাবছর ৪ ফুটের উর্ধে থাকা প্রয়োজন হয়। 

    ৪। মাছের মোটাতাজা করন এর জন্যে খাদ্য চাহিদা কতটুকু ?

    এই পদ্ধতিতে মাছ চাষ করলে বাইরে থেকে কম খাদ্য দিলেই হয় যদি পুকুরে পর্যাপ্ত পরিমানে প্ল্যাঙ্কটন থাকে। তবে বাইরে থাকে খাদ্য দিলে মাছের দৈহিক ওজনের  ১.৫ থেকে কমে ০.৫ % খাদ্য প্রয়োজন হয় এবং হাতে তৈরী । 

    আরও দেখুন-



    একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

    0মন্তব্যসমূহ

    একটি মন্তব্য পোস্ট করুন (0)