বীজ আলু উৎপাদনের পদ্ধতি । আলুর প্রকৃত বীজ থেকে আলু চাষ করে

Didibhai Agrofarm
0
বীজ আলু উৎপাদনের পদ্ধতি । আলুর প্রকৃত বীজ থেকে আলু চাষ করে

আমরা বীজ বা বীচন আলু থেকেই আলু চাষ করে অভ্যস্থ। আমরা অনেকেই জানিনা আলুর টমেটো, বেগুনের মত ফলহয়,বীজ হয় আর তা থেকে আলু চাষও করা যায়। আলুর ফল থেকে যে বীজ সংগ্রহ করা হয় তাকেই প্রকৃত আলুবীজ বা ট্রু পটাটো সিড বা সংক্ষেপে টি.পি.এস. বলা হয়। এই টি.পি.এস বা প্রকৃত আলুবীজ উৎপাদন করতে হলে বিশেষ ব্যবস্থা ও কৌশল দরকার হয় যা সর্বত্র সবার জন্যও সব পরিবেশে উপযুক্ত নয়। দেশের উত্তর পূর্ব ও উত্তরাঞ্চলের কেন্দ্রীয় আলু অনুসন্ধান সংস্থা, সিমলা ও ত্রিপুরা সরকারের উদ্যান অনুসন্ধান কেন্দ্র, নাগিছড়া এই বীজ উৎপাদন ও বিপনন করে থাকেন। ৭৫ বিঘা চাষের জন্য এক কিলো প্রকৃত বীজ দরকার হয়। আমাদের রাজ্যে ইলামবাজার, লাভপুর, ইটাহার, হরিরামপুর, কালচিনি ও ঝালদা-২ নং ব্লকে আন্তর্জাতিক আলু বর্ষে (২০০৭ সাল) এইচ পি এস - ১/১৩ জাতের বীজ নিয়ে বেশ কিছু চাষী এই চাষ করছে।এখানে মূলত প্রকৃত আলু বীজ থেকে খাবার যোগ্য,বাজারের উপযুক্ত আলু চাষ পদ্ধতি আলোচনা করা হল। এই পদ্ধতিতে চাষের জন্য নিশ্চিত সেচের প্রয়োজন হয়। 

    ১.উদ্দেশ্য-

    প্রকৃত বীজ থেকে দুটো উদ্দেশ্যে আলুর চাষ হয়-

    ক)বীজ থেকে চারা তৈরী করে আলু উৎপাদ। 

    খ)বীজ থেকে চারা তৈরী করে বীজ আলু বা বীচন আলু (আলুর ছোট ছোট কন্দ) উৎপাদন। 

    ২. বীজের প্রয়োজন -

     এক বিঘা আলু চাষের জন্য মাত্র ১৬-১৭ গ্রাম প্রকৃত বীজ দরকার হয়। 

    ৩.বীজতলা তৈরী -

    ক) প্রথমে বীজতলায় চারা তৈরী করতে হবে। এক বিঘার জন্য ১০ বর্গ মিটার অর্থ্যাৎ ১ মিটার চওড়া ১০ মিটার লম্বা নার্সারী বা বীজ তলা লাগবে। আপনার বীজতলার জায়গা অনুযায়ী বীজতলার বেডের দৈর্ঘ্য হেরফের হবে৷ 

    খ)  বীজ তলার জায়গাটির উপর থেকে ২-৩ ইঞ্চি মাটি সরিয়ে ফেলতে হবে। ২-৩ ইঞ্চি তলার মাটি বীজতলার জন্য নিতে হবে।

    গ)এবার বীজতলার জন্য সার মাটি তৈরী করতে হবে। এবার মাটির সাথে সম পরিমান ভাল পচা গোবর সার বা কম্পোষ্ট বা ভার্মিকম্পোষ্ট সার বা বায়ো গ্যাসের স্লারি মিহি করে মিশিয়ে সমান ভাবে বেড তৈরীর জন্য বিছিয়ে নিতে হবে। এরপর ভাল মানের গোবরসার বা কম্পোষ্ট সার বা ভার্মি কম্পোষ্ট বা বায়োগ্যাসের স্লারি গুঁড়ো করে চালনীতে ছেঁকে বেড়ের সার মাটির উপর ২-৩ ইঞ্চি পুরু করে সমান ভাবে বিছিয়ে দিতে হবে। এ ভাবে বেড়ের উচ্চতা প্রায় চার ইঞ্চি দাঁড়াবে। বেডের চার পাশে ইট বা বাঁশ, কাঠের আল বেঁধে দেওয়া দরকার যাতে বেডের মাটি ধুয়ে না যায়।

    ৪.চারা তৈরী 

    ক) বীজ বোনার আগের দিন হালকা সেচ দিয়ে বেডের মাটি ভিজিয়ে দিতে হবে।

    খ) পরের দিন হালকা কোদালী করে মাটি কুপিয়ে ঝুড়ঝুড়ে করে সমান করে সাজিয়ে নিতে হবে, যাতে মাটিতে উপযুক্ত রস থাকে৷ এতে বীজ একসাথে ভাল ভাবে অঙ্কুরিত হবে। 

    গ)এবার বেডের আড়াআড়ি ১০ সেমি বা ৪ ইঞ্চি তফাতে ৪-৫ মি.মি. গভীর করে বাঁশের আঁকশি বা দাঁড়া দিয়ে দাগ টেনে দাগ বরাবর বীজ বুনতে হবে- যেমন কপি, টমেটোর বীজ বোনা হয়। বীজের দুরত্ব ঠিক রাখা কঠিন । তবু আনুমানিক প্রতি সেন্টিমিটারে ১ - ২টি করে বীজ পড়লে ভাল হয়। প্রয়োজনে বালি মিশিয়ে নিলে বীজ ছড়াতে সুবিধা হয়।

    ঘ) বীজ বোনার পর চালনী দিয়ে ছাকা ঝুড়জুড়ে গোবর সার বা ভার্মি কম্পোষ্ট বা কম্পোষ্ট সার ছাকনীতে নিয়ে ঝাঁকিয়ে ঝাঁকিয়ে ২-৩ মি.মি. পুরু করে বীজ ঢেকে দিতে হবে।

    ঙ)  বীজ ঢাকার পর স্প্রেয়ার দিয়ে বীজতলা সাবধানে হালকা করে এমনভাবে ভিজিয়ে দিতে হবে যাতে বীজ সরে না যায় ও জল বয়ে না যায়, সবটাই টেনে নেয়৷

    চ) খড় দিয়ে বেড ঢেকে রাখা যেতে পারে অন্যথায় প্রথম সপ্তাহে দিনে ৩-৪ বার স্প্রেয়ার দিয়ে হালকা সেচ দিতে হবে।

    ছ) ২য় সপ্তাহ থেকে (বীজ গজানোর পর থেকে) খড়ের ঢাকনা সরিয়ে দিতে হবে ও একইভাবে হালকা করে সেচ দিতে হবে।

    জ) বীজ বোনার পর দুই সপ্তাহ ধরে যদি দিনের তাপমাত্রা ৩০ ডিগ্রি সেলসিয়ার্স এর বেশী চলতে থাকে তবে পাতলা কাপড় বা চট্‌ দিয়ে সকাল ১০ টা থেকে বিকেল ৫ টা পর্যন্ত ছায়া দেবার ব্যাবস্থা রাখতে হবে (যেমন কপি, টমেটো ইত্যাদির চারা তৈরীতে ছায়ার ব্যবস্থা থাকে)। দু সপ্তাহে চারা দু পাতার হয়ে যাবে।

     ঝ) চারা দু পাতার হয়ে যাবার পর থেকে দু তিন দিন পর পর ১ গ্রাম ইউরিয়া প্রতি লিটার জলে গুলে চার পাঁচ পাতা হওয়া পর্যন্ত বিকালে স্প্রে করা যেতে পারে। বিকল্প হিসাবে ১৫ শতাংশ টাটকা গোবর জলের নির্যাস (১৫০ গ্রাম টাটকা গোবর ১ লিটার জলে ১ বেলা ভিজিয়ে টলটলে নির্যাস) ব্যবহার করে উপকার পাওয়া গেছে। এটি সারের কাজও যেমন করে তেমনি গোরা পচা, পাতা ধসা ইত্যাদি রোগও সামাল দেয়া বেডে উপযুক্ত রস না থাকলে বা বীজ বেশী গভীরে দিলে চারা বেরতে দেরী হয়। চারা চার পাঁচ পাতা হলে মূল জমিতে লাগানোর উপযুক্ত হয়।

    ৫।মূল জমি তৈরী-

    ক) প্রথম চাষে বিঘাপ্রতি দুই-তিন হাজার কিলো (৬-৭ গরুর গাড়ি) ভাল জৈবসার দিয়ে মূল জমি ৪-৫ বার চাষ করে ঝুরঝুরে করে মাটি তৈরী করতে হয়। জমি শুকনো হলে প্রয়োজনে প্রথম চাষের ১-২ দিন আগে মূল জমিতে সেচ দিয়ে নিলে মাটি তৈরী সুবিধা হবে।

    খ) শেষ চাষে মোট রাসায়নিক সারের সম্পূর্ন ফসফেট ও পটাশ সার এবং অর্দ্ধেক নাইট্রোজেন সার ভাল করে মাটিতে মেশাতে হবে।

    গ) মই দিয়ে মাটি সমান করে নিতে হবে। ঘ)এরপর পূর্ব-পশ্চিমে লম্বা করে ৪০-৪৫ সেমি (১৬-১৮ ইঞ্চি) দুরত্বে ২০ সেমি বা আট ইঞ্চি উঁচু করে আল তুলতে হবে যার গায়ে চারা লাগানো হবে।

    ঙ) চারা লাগানোর আগের দিন আলের অর্দ্ধেক বা ৪ ইঞ্চি পর্যন্ত সেচের জল দিতে হবে।

    চ) সেচের পরদিন দুপুরের পর আলের গায়ে উত্তর পাশে চারা লাগাতে হবে।

    ৬.চারা লাগানো-

    ক) বীজতলা থেকে সাবধানে চারা তুলে মূল জমিতে চারা নেবার সময় ঝুড়িতে বসিয়ে সাবধানে নিতে হবে যাতে চারা ভেঙ্গে না যায়।

    খ) এবার চারা লাগানোর জন্য তৈরী আলের উত্তর পাশে সেচের জলের দাগ ধরে ১৫ সেমি (ছয় ইঞ্চি) দুরত্বে খুরপীর সাহায্যে চারা লাগাতে হবে।

    গ) চারা লাগানোর পর ভেলিতে হালকা সেচ দিতে হবে। এভাবে আলের পর আল চারা লাগাতে হবে ও হালকা সেচ দিতে হবে। ঝাড়ি দিয়ে দিতে পারলে ভাল হয়।

    ঘ) চারা লাগানোর পর চারা বসা বা লেগে যাওয়া পর্য্যন্ত ৩-৪ দিন পর পর হালকা সেচ দিতে হবে।

    ঙ) চারা বসে গেলে বা ধরে গেলে ৮-১০ দিন অন্তর সেচ লাগবে।

    চ) চারা লাগানোর ৩০-৩৫ দিন পর গোড়ায় মাটি ধরানোর কাজ করতে হবে।

    ছ) গোড়ায় মাটি ধরানোর সময় বাকি অর্ধেক নাইট্রোজেন সার চাপান হিসাবে দিতে হবে।

    জ) গোড়ায় মাটি ধরানো এমনভাবে করতে হবে যেন চারাগুলি আলের মাঝে চলে আসে অর্থাৎ উত্তরের আলের দক্ষিনের মাটি ভেঙ্গে দক্ষিণের আলের চারার গোড়ার ধরাতে হবে(কারণ আলের গায়ে উত্তর পাশে চারা লাগানো হয়েছিল)। চারার গোড়া থেকে দ্বিতীয় বা তৃতীয় গাঁট পর্যন্ত মাটি তোলা যাবে। এর বেশী নয়। 

    ঝ)সারের পরিমাণ, অন্যান্য পরিচর্য্যা ওই এলাকার আলু চাষে যা করা হয় তেমনি ভাবে করতে হবে।

    ৭.সময় কাল ও ফলন-

    ক)চারা ৪-৫ পাতা হতে তিন সপ্তাহ লাগে। চারা মূল জমিতে লাগানোর পর ৬০ দিন থেকেই আলু তোলা যায়৷ তবে মূল জমিতে ৮০-৯০ দিন রাখলে ফলন ক্রমে বাড়তে থাকে।

    খ) ফসল তোলার ২০ দিন আগে সেচ বন্ধ করে দিতে হবে।

    গ) আলু তোলার ১০ দিন আগে মাটির কাছাকাছি থেকে গাছ কেটে দিতে হয়। এতে আলুর কন্দের ছাল শক্ত হয়, বেশী দিন সহজে রাখা যায়।

    ঘ) এরপর আলু তোলা হয়। তোলার পর ৪০ গ্রাম পর্যন্ত ওজনের আলু পরের বছর বীচন আলুর জন্য রাখা লাভজনক ৷ তবে খাওয়াও চলে।

    ঙ) বীচন হিসাবে ছোট বীজ আলু রাখতে হলে ৩% বোরিক অ্যাসিডের জলীয় দ্রবণে ৩০ মিনিট ডুবিয়ে, ছায়ায় শুকিয়ে ঠান্ডা ও অবাধে নির্মল বাতাস চলাচল করে অথচ রোদ ঢোকেনা এমন ঘরে বাঁশ বা কাঠের মাচায় পরের বছরের বীচনের জন্য রাখা যাবে। ১০০০ কিলো বীচন আলু বিছিয়ে নিয়ে ১৪ লিটার ৩% বোরিক অ্যাসিডের জলীয় দ্রবণ স্প্রে করে নিলেও চলবে।

    চ) এই বীচন আলুর মাধ্যমে নানা রোগ আসার সম্ভবনা খুবই কম থাকে৷

    ছ) ৪০ গ্রামের বেশী ওজনের আলু খাবার জন্য বা বাজারে বিক্রির জন্য ব্যবহার করা যাবে৷

    ৮।লাভ -

    আলু চাষের প্রধান খরচ আলুর বীজ। এই পদ্ধতিতে আলু চাষ করে বীজ সংগ্রহ করে রাখলে খরচ কমে যায় এবং দ্বিগুন লাভের সম্ভাবনা তৈরী হয়। 

    ৯.তথ্য সূত্র -

    ১.ড: বিবেকানন্দ সান্যাল -লোক কল্যাণ পরিষদ 
    ২.ত্রিপুরা সরকার হর্টিকালচার বিভাগ 

    আরও দেখুন 

    ১.শতমূলী চাষ পদ্ধতি

    ২.জৈব কীটনাশক তৈরী পদ্ধতি



    একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

    0মন্তব্যসমূহ

    একটি মন্তব্য পোস্ট করুন (0)