পেনে মাছ চাষ পদ্ধতি (Pen Culture system )

Didibhai Agrofarm
0
পেনে মাছ চাষ  পদ্ধতি


 পেনে মাছ চাষ (Pen Culture) কোন উন্মুক্ত বা আবদ্ধ জলাশয়ে এক বা একাধিক বাঁশ, বানা, বেড়া, জাল বা অন্য কোন উপকরণ দ্বারা ঘিরে উক্ত ঘেরের মধ্যে মাছ মজুত করে চাষ করাকে পেন (Pen) বা ঘেরে মাছ চাষ বলে। পেনে মাছ চাষের বৈশিষ্ট্য হল পেনের ঘের বা বেড়া জলাশয়ের মাটিতে প্রােথিত বা আবদ্ধ থাকে এবং পেনের জলের সঙ্গে বাইরের জলের সংযােগ বা প্রবাহবিদ্যমান থাকে। 

    ১।/পেনে মাছ চাষের সম্ভাব্য স্থান 

    আবদ্ধ জলাশয়, উন্মুক্ত জলাশয়, সমুদ্র উপকূলের অগভীর অঞ্চল ইত্যাদি প্রায় সকল প্রকার জলাশয়েই পেনে মাচ চাষ করা সম্ভব। যে সব জলাশয়ে সাময়িক কিংবা স্থায়ীভাবে জল থাকে যেমন সেচ প্রকল্পের বরােপিট খাল, সেচ প্রকল্পের সংযােগ খাল, রাস্তার পার্শ্বস্থ খাল, বন্যাপ্লাবিত জলাভূমি, বিলবাওড় প্রভৃতিতে পেনের মাধ্যমে চাষ করা সম্ভব। এছাড়া যে সমস্ত জলাশয়ের একাধিক মালিকানা থাকায় সঠিকভাবে মাছ চাষের আওতায় আনা সম্ভব হচ্ছে না, এইসব জলাশয়ে পেন তৈরীর মাধ্যমে মালিকানা সমস্যার সমাধান এবং উন্নত মাছ চাষ করে দেশে মাছের উৎপাদন বাড়ানাে সম্ভব। তবে পেনের জন্য স্থান নির্বাচন করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। যেসব জলাশয়ের তলদেশে অত্যন্ত অসমান বালি ও পাথর থাকে, জল দূষণের সম্ভবনা আছে, প্রবল স্রোত বিদ্যমান, ঝড়াে হাওয়ায় আক্রান্ত হওয়ার সম্ভবনা আছে সেই সব স্থান নির্বাচন না করা উচিত। পেন জলাশয়ের খুব গভীর অংশে নির্মাণ করা যাবে না। জলের গভীরতা ১ মিটার থেকে ২ মিটারের মধ্যে থাকবে এবং পাড় থেকে আলতাে ঢালু থাকবে এমন জায়গা পেন স্থাপনের জন্য নির্বাচন করা ভালাে। এছাড়া মাটির তলদেশে বালি মিশ্রিত কাদাও পেনের পক্ষে আদর্শ স্থান। 

    ২।পেনে মাছ চাষের সুবিধাঃ 

    ১) সামান্য মূলধন ও অল্প সময়ে পেন তৈরী করে মাছ চাষ করা যায়। 

    ২) যে জলাশয়ের একাধিক মালিকানা আছে সে সব জলাশয়ে পেন তৈরীর মাধ্যমে মালিকানা সমস্যার সমাধান করা যায় এবং একই জলাশয়ে একাধিক মৎস্যজীবি নিজেদের পছন্দমত মাছ চাষ করতে পারেন। 

    ৩) পেনে সমন্বিতভাবে হাঁস বা মুরগীর সঙ্গে মাছ চাষ করা যায়।। 

     ৪) প্রয়ােজনবােধে অল্প সময়ে পেন স্থানান্তর ও তৈরী করা যায়। |

     ৫) প্রয়ােজনে যে কোন সময়ে সামান্য শ্রম ও কম খরচে পেনে মাছ ধরা সম্ভব। 

    .৩।পেনের আকার ও নির্মাণ সামগ্রীঃ

    পেনের আকার জলাশয়ের আকার, জলাশয়ের মলিকানার সংখ্যা এবং ব্যবস্থাপনা ইত্যাদির উপর নির্ভর করে। পেনের আয়তন ০.১ হেক্টর কিংবা তার চাইতেও বেশী হতে পারে। তবে তুলনামূলকভাবে ছােট আকারের পেন মাছ চাষ ও ব্যবস্থাপনার দিক থেকে সবচেয়ে ভালাে।।

    | জলাশয় ভেদে পেন তৈরীর জন্য বহুবিধ দ্রব্য ব্যবহার হয়ে থাকে। তবে পেন তৈরীর প্রধান দুটো উপাদান হলাে পেনের মধ্যে মাছ আবদ্ধ রাখার জন্য বেড়া (Fencing) এবং বেড়া ধরে রাখার জন্য খুঁটি। সাধারণতঃ বাঁশের তৈরী বানা, বেড়া, নাইলন জাল, সূতার জাল, টায়ার কর্ডের জাল, তারের জাল ইত্যাদি বেড়া হিসাবে ব্যাহার করা হয়। খুঁটির জন্য বাঁশ, কাঠ, লােহার পাইপ, সিমেন্টের খুঁটি ইত্যাদি ব্যবহার করা হয়। এছাড়া কিছু নাইলন ও নারিকেল দড়িও পেন তৈরীতে লাগে। 

    .৪।পেন তৈরীর পদ্ধতিঃ

    | পেন তৈরীর জন্য নির্বাচিত স্থানের পরিমাপ গ্রহণ করে প্রথমে বানা/বেড়া, জাল এবং খুঁটি প্রস্তুত করে নিতে হবে। বানা/বেড়া ও জালের প্রস্থ সর্বোচ্চ গভীরতার চেয়ে ২-৩ ফুট বেশী রাখতে হবে। খাল বা লম্বা আকৃতির জলাশয় হলে জলাশয়ের এক পাড় থেকে অন্য পাড় পর্যন্ত আড়াআড়ি ভাবে খুঁটির বাইরের দিকে জল প্রবাহের দিকে প্রথমে জাল ও জালের বাইরে বেড়া স্থাপন করতে হবে। যে সব এলাকায় জলের প্রবাহ বেশী সেই সব এলাকায় বানার তলদেশের বেশকিছু অংশ (কমপক্ষে ১-২ ফুট) মাটিতে পুঁতে দিতে হবে। একইভাবে জালের নিমাংশ হুক বা বাঁশের খিলার সাহায্যে ভালােভাবে গেঁথে দিতে হবে যাতে জল। প্রবাহের জন্য তলদেশের মাটি সরে গিয়ে জাল বা বানা পৃথক হয়ে না যায়। অতঃপর জাল এবং বানা। আড়াআড়ি ভাবে দড়ি দিয়ে খুঁটির গায়ে ভালােভাবে বেঁধে দিতে হবে। উন্মুক্ত স্থানে পেন হলে খুঁটির মাঝামাঝি জায়গায় ডান ও বাম দিকে গ্যালভানাইজড তার/পলিথিন/নাইলনের দড়ি দিয়ে টান বা বাঁশ দিয়ে ঠেস দেওয়া আবশ্যক যাতে ঝড়াে বাতাসে পেন পড়ে না যায়। বানা এবং জালের ফাস এমনভাবে তৈরী হওয়া দরকার যাতে জলের প্রবাহ সর্বদা সচল থাকতে পারে। কিন্তু মজুতকৃত পোনা মাছ এর থেকে বেড়িয়ে যেতে না পারে। জালের ফাস নির্বাচন করার ক্ষেত্রে তাই বিশেষ সতর্ক দৃষ্টি দিতে হবে, জালের ফাঁসের মাপের উপর মাছের চারাপােনা ছাড়ার সাইজ নির্ভর করে। উন্মুক্ত জলাশয়ে পেন তৈরী করলে যেখানে জলের প্রবাহ ভালাে থাকে সেখানে ১.৫-২.০ সেমি মাপের জালের ফাঁস হওয়া উচিত। নচেৎ চারাপােনা পেন থেকে বেরিয়ে যাওয়ার আশংকা থাকে। পেনের বেড়া তৈরীর জন্য শুধু জাল বা বানা বা অধিক নিরাপত্তার জন্য জাল ও বানা দুটো একসাথেও ব্যবহার করা যেতে পারে। 

    ৫।মাছ মজুদের জন্য পেনের রাক্ষুসে ও অবাঞ্ছিত মাছ দমন 

    রাক্ষুসে মাছ পেনে থাকলে মজুতকৃত পােনা মাছ খেয়ে ফেলবে এবং রাক্ষুসে মাছ ও অন্যান্য অবাঞ্ছিত মাছ পেনের প্রাকৃতিক খাদ্য খেয়ে মজুতকৃত মাছের বৃদ্ধি ও উৎপাদন ব্যাহত করবে। বড় বড় জলাশয়ে কিংবা বিলে পেন তৈরী করলে যেখানে পেনের সঙ্গে পেনের বাইরের জলাশয়ের অংশের সংযােগ থাকে সেখানে মহুয়া খােল প্রয়ােগ করে খুব একটা ফল পাওয়া যায় না। তাই ছােট ফাঁসের জাল পরপর কয়েকবার টেনে রাক্ষুসে মাছ ও অবাঞ্ছিত মাছ অপসারিত করতে হয়। পেনে জলজ আগাছা থাকলে মাছ ছাড়ার পূর্বে অবশ্যই তা পরিস্কার করতে হবে। এই সমস্ত জলাশয়ে জলের প্রবাহ থাকায় পেনে চুন ও সার প্রয়ােগ করে কাংক্ষিত ফল পাওয়া যায় না। তবে প্রয়ােজন বােধে অল্পমাত্রায় মাঝে মাঝে চুন প্রয়ােগ করা যেতে পারে। পেনের যে দিকে মাটির পাড় থাকে সেখানে জলজ আগাছা স্তুপীকৃত করে কম্পােস্ট সার তৈরী করে নিলে ওখান থেকে পুষ্টিজাত পদার্থ নির্গত হয়ে জলে পড়লে পেনের প্রাকৃতিক খাদ্যকণা তৈরী হতে। থাকবে কিংবা পেনের কাছে বা পাড়ে হাঁস, মুরগীর ঘর থাকলে ভালাে। এর থেকেও জৈব সার সরাসরি পেনের জলে মিশ্রিত হয়ে পেনের উর্বরতা বৃদ্ধি করবে।

    | কিন্তু যে সমস্ত পেন বাঁশের বানা দিয়ে তৈরী হয় এবং এর সঙ্গে খুব ঘন ফাঁসের জাল থাকে সেখানে। সার ও চুন প্রয়ােগ সাধারণ মাছ চাষে যেভাবে করা হয় সেভাবে করা যেতে পারে। কারণ এই সমস্ত পেনে জল মােটামুটি আবদ্ধ অবস্থায় থেকে যায়, জলের প্রবাহ হয় না বললেই চলে।

    ৭।পোনা মজুদকরণ -

    পেনে মাছ চাষের জন্য মাছের প্রজাতি এমনভাবে নির্বাচন করতে হবে যাতে বিভিন্ন প্রজাতির মাছ। এলের সকল স্তরের খাবার খায়, যাদের খাদ্যশৃঙ্গাল সংক্ষিপ্ত, কম দামী খাবার খায়, যাদের পােনা অহজলভ্য এবং অল্প সময়ে চাষ করে বিক্রয় উপযোগী করা যায়। এই সব দিক বিবেচনা করে রুই, কাতলা, মৃগেল, সিলভার কার্প, গ্রাস কাপ, বাটা, কমন কার্প প্রভৃতি মাছ মজুত করা যেতে পারে।

    অধিক ফলনের জন্য সুস্থ ও সবল পেনা নির্দিষ্ট হারে মজুত করা আবশ্যক। পােনা মজুতের সময় লক্ষ্য রাখতে হবে যাতে পােনার আকার কোন মতেই ৩-৪ ইঞ্চির কম না হয় কারণ ছােট পােনা পেনের বেড়াজালের ফাঁস দিয়ে বের হয়ে যেতে পারে। এছাড়াও পেন থেকে রাক্ষুসে মাছ অনেক সময় সরিয়ে ফেলা সম্ভব হয় না। তাই ছোট সাইজের পােনা মজুত করলে রাক্ষুসে মাছগুলাে দ্বারা পোনা খেয়ে ফেলার সম্ভাবনা থাকে।

    ৮।পেনে মাছের খাদ্য সরবরাহ -

    | সেচ প্রকল্পের খাল, হ্রদ বিল প্রভৃতি এলাকার জল অত্যন্ত উর্বর এবং প্রচুর পরিমাণে প্রাকৃতিক খাদ্য থাকলেও শুধু মাত্র প্রাকৃতিক খাদ্যের উপর নির্ভর করে অধিক উৎপাদন পাওয়া যায় না। পেনে মাছের মজুতের ঘনত্ব বেশী হলে অতি অবশ্যই পরিপূরক খাদ্য প্রয়ােগ করা দরকার। 

    .৯।পেন পরিচর্যা ও চাষ ব্যবস্থাপনাঃ

    পেনে জাল টেনে মাসে কমপক্ষে একবার মাছের বৃদ্ধি, রােগ ইত্যাদি পর্যবেক্ষণ করা আবশ্যক। প্রতিমাসে কমপক্ষে একবার মাছের নমুনা সংগ্রহ করে মাছের বৃদ্ধি অনুযায়ী পরিপূরক খাদ্যের পরিমাণ নির্ধারণ করে খাদ্য প্রয়ােগ করতে হবে। এছাড়াও পেনের বেড়া ও জালের কোনরূপ ক্ষতি হচ্ছে কিনা সে বিষয়ে লক্ষ্য রাখতে হবে। অনেক সময় পেনের বেড়ায় ও জালে ময়লা ও আবর্জনা জমে জলের প্রবাহ বন্ধ হয়ে যায়। এইরূপ অবস্থার সৃষ্টি হলে বেড়া ও জাল পরিস্কার করতে হবে না হলে জলের চাপে জাল ছিড়ে যেতে পারে ও বেড়া ভেঙ্গে যেতে পারে।

    .১০।মাছের উৎপাদন -

    পেনে মাছের উৎপাদন সাধারণতঃ নির্ভর করে

    ১) মাছ চাষের এলাকা ও তার পরিবেশগত অবস্থা ২) মাছ চাষের জন্য প্রজাতি নির্বাচন ৩) মাছের মজুদ ঘনত্ব ৪) মাছের বেঁচে থাকার হার ৫) মাছ চাষ পদ্ধতি ও তার ব্যবস্থা

    .১১।পেনে মাছ চাষের সতর্কতা -

    ১) উন্মুক্ত স্থানে পেন তৈরী করা হলে প্রাকৃতিক দূর্যোগে পেনের ক্ষতি হবার সম্ভাবনা থাকে।

     ২) যে সব নদ-নদী বা খালে প্রবল স্রোত ও ঢেউ থাকে সে সব জায়গায় পেন তৈরী করলে ভেঙ্গে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে। 

    ৩) পেন থেকে মাছ চুরি হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা খুবই বেশী। 

    ৪) পেনে জাল বা বানা ক্ষতি হলে তা থেকে মাছ বেড়িয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে। তাইপেনে মাছ চাষ করলে পেন পরিচর্যা ও রক্ষণাবেক্ষণের জন্য অতি অবশ্যই সবসময়ের জন্য। পেনের কাছে পাহারার ব্যবস্থা থাকা দরকার।

    তথ্য সূত্র -

    পশ্চিমবঙ্গ সরকার মৎস বিভাগ।  
    আরও দেখুন --

    একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

    0মন্তব্যসমূহ

    একটি মন্তব্য পোস্ট করুন (0)