সুস্থায়ী কৃষি ব্যবস্থাপনা জৈব সারের গুরুত্ব

Didibhai Agrofarm
0
সুস্থায়ী কৃষি ব্যবস্থাপনা জৈব সারের গুরুত্ব

মাটি, জল, আঞ্চলিক প্রাণসম্পদ নষ্ট না করে, প্রকৃতির স্বাভাবিক শক্তিকে ব্যবহার করে এবং তাকেই আরও মজবুত করে যে চাষবাস বা পশুপালন তাকেই বলা হয় সুস্থায়ী কৃষি। সুস্থায়ী কৃষিতে কৃষক প্রধানত তাঁর খামারে এবং আশপাশের প্রকৃতি-পরিবেশে পাওয়া যায় এমন উপাদান বিভিন্ন প্রক্রিয়া করণের মাধ্যমে বা সরাসরি ব্যবহার করে চাষবাস করেন ফলে তাঁর খরচা খুব কম থাকে এবং এই ক্ষেত্রে যা কিছু ব্যবহার হয় সব কিছুই জৈবিক প্রাপ্ত বাজার থেকে আলাদা করে ক্রয় করতে হয় না ।

 টেকসই বা স্থায়ী কৃষি করতে হলে ব্যবহারের পরে তার অবশেষে রূপে পরবর্তী চাষে জমিতে পাওয়া যায় ফলে গাছের খাদ্য উপাদানের যোগান জমিতে স্থায়ী হতে থাকে এবং বাইরে থেকে নতুন করে অধিক খাদ্য যোগানের প্রয়োজন হয় না।  এর ফলে চাষ লাভজনক হয় এবং এই কারণেও এই চাষ সুস্থায়ী বা টেকসই। তাই টেকসই চাষ করতে হলে জৈব উপাদান যুক্ত জৈব সারের ভূমিকা বা গুরুত্ব অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। 

    1.সুস্থায়ী কৃষির পথে -

    পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন জনগােষ্ঠী পরম্পরাগত ও বৈজ্ঞানিকভাবে প্রমাণিত জ্ঞানের একাধিক সমাবেশ ঘটিয়ে কৃষি ব্যবস্থা থেকে সুস্থায়ী আয়ের উপায় বের করেছেন। এই ব্যবস্থা প্রায়শই পরিবেশ বান্ধব। ভারতবর্ষের অন্যান্য রাজ্যের মত আমাদের রাজ্য পশ্চিমবঙ্গে-ও কৃষকেরা শস্য উৎপদনে প্রাণীপালণে, মৎস্য চাষে এই ধরনের কৃৎ-কৌশল প্রয়ােগ করে উপকার পেয়েছেন। 

    উদাহরণ হিসাবে বলা যায় মাটির স্বাস্থ্য রক্ষায় যুগ যুগ ধরে গােবরসার, বিভিন্ন প্রাণী বর্জ্য পদার্থ থেকে উৎপন্ন সার, পুরােনাে পুকুরের পাঁক ব্যবহার, ফসলের সুসংহত রােগ পােকা নিয়ন্ত্রণ, ফসলের বন্ধু পােকা ও শত্রু পােকাকে চিহ্নিত করে বন্ধু পােকার বংশবৃদ্ধি ঘটিয়ে শত্রুপােকার। নিয়ন্ত্রণ করা। পদ্ধতিটি প্রথা নির্ভর যেমন, মাঠের ফসল পেকে আসার সময়ে মাঠে ইদুরের উপদ্রব বাড়ে। কিছু ফসল নষ্ট হয়। 

    প্রতিকারের উপায় হিসাবে আমাদের বাংলার অনেকেই পাকা ফসলের ক্ষেতে রাত্রে পেঁচা সবার উপযােগী গাছের ডাল পুঁতে দেন। মাঠের ফসলের রােগ পােকা নিয়ন্ত্রণে নিম, নিশিন্দা, পড়াশি, কুর্চি ইত্যাদি গাছের পাতা অথবা পাতার নির্যাস ব্যবহার করেন। জমির ধারে ধারে আলাের ফাঁদ, ফেরােমন ফাঁদ, আঠা লাগানাে হলুদ রং এর প্লেট ইত্যাদি প্রযুক্তি ব্যবহার করে পােকা নিয়ন্ত্রণ করা, এবং রাসায়নিক কীটনাশকের ব্যবহার কমিয়ে আনা তাঁদের লক্ষ্য। যেমন মাটির স্বাস্থ্যের কথা মাথায় রেখে অজৈব রাসায়নিক সারের ব্যবহার কমিয়ে এনে বিভিন্ন জৈব সার যেমন কম্পােস্ট সার, কেঁচো সার, জীবানু সারের প্রচলন বাড়ানাে এবং একই সাথে সুস্থায়ী কৃষি ব্যবস্থার মাধ্যমে সুস্থায়ী আয় সুনিশ্চিত করার চেষ্টা করে চলেছেন। 

    2.সুস্থায়ী কৃষির প্রয়জোনীয়তা -

    কৃষি দারুণভাবে প্রকৃতিনির্ভর। মাটি জল প্রভৃতির গুণমান অক্ষুন্ন না থাকলে কৃষি লাভজনক বা টেকসই থাকে না। এই কারণেই এমন কৃষিপদ্ধতি অনুসরণ করা উচিত যা প্রকৃতি পরিবেশের শক্তিকে অক্ষুন্ন রাখবে। টেকসই কৃষি তাই করে এবং এটাই তার প্রয়ােজনীয়তা। তাছাড়া, প্রকৃতি-পরিবেশের স্বাভাবিক শক্তিকে ব্যবহার করে চাষবাস করলে চাষের খরচ কমে। তা বিশেষ করে গরিব মানুষের পক্ষে লাভজনক ও সেই কারণেও টেকসই হয়।

    দেশের গরিব মানুষের জীবিকার প্রায় সবচেয়ে জোরদার বুনিয়াদ চাষবাস। যেসব মৎস্যজীবী মাছ ধরেন, তাঁদের অনেকেই কিছু চাষবাসও করেন। চাষবাস মানে শুধু ক্ষেতে কাজ নয়, মাছ কাঁকড়া চাষ, হাঁস-মুরগি-ছাগল পালন ইত্যাদি। যাঁরা বলেন চাষবাস লাভজনক নয়, তাঁরা দামি প্রযুক্তির কথা মাথায় রেখে বলেন। এই প্রযুক্তির মধ্যে রয়েছে বাজারে কেনা কোম্পানি-নির্মিত সংকর বীজ, রাসায়নিক সার এবং কৃত্রিম কীটনাশকের ব্যবহার। এইসবের ব্যবহার চাষির পক্ষে লােকসানের। তাই গরিব মানুষের চাষের ক্ষেত্রে ব্যবহার করতে হবে দেশি বীজ, সহজলভ্য জৈব সার, সুসংহত শত্রুপােকা নিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি এবং প্রয়ােজনে জৈব কীটবিতাড়ক। (গ্রামে ব্যবহৃত জৈব সারের একটা সস্তা উৎস হতে পারে শহরের বিপুল জঞ্জালের একটা বড়াে অংশ। এর মাধ্যমে শহরের আবর্জনা ব্যবস্থাপনা লাভজনক হয়ে উঠতে পারে।)

     এইসব পদ্ধতিতে চাষের খরচ দারুণভাবে কমে এবং চাষ সহজে লাভজনক হয়ে ওঠে। এক্ষেত্রে যা স্বল্প খরচার, তা পরিবেশেরও অনুকূল। আবার পরিবেশের অনুকূল বলেই তা সুস্থায়ী জীবিকা পথ সুগম করে। কারণ মাটি, জল, পশু পাখি উদ্ভিদ পােকামাকড় কেঁচো প্রভৃতি সম্পর্কে বৈজ্ঞানিক জ্ঞান ও পদ্ধতির সঙ্গে পরম্পরাগত অভিজ্ঞতার মিলন ঘটিয়ে চাষবাস করলে মাটি হয়ে ওঠে উর্বর, ফসল, গরু, ভেড়া, ছাগল, হাঁস, মুরগি, মাছ হয় স্বাস্থ্যবান। এর ফলে চাষের খরচ কমতে ও উৎপাদন বাড়তে থাকে। চাষ পরিবারের খাদ্য ও পুষ্টি সুরক্ষার সঙ্গে সঙ্গে লাভজনক ব্যাবসা হয়ে ওঠার সুযােগ পায়। সর্বোপরি চাষির এবং চাষির খরিদ্দার কারুর কোনাে শারীরিক ক্ষতি হয় না ।

    3.সুস্থায়ী কৃষির উপাদান গুলি -

     চাষ করতে হলে প্রধান উপাদান যেটি সেগুলি হল মাটি ,জল ,বায়ু ,বাতাস ,চাষের শ্রম ও সঠিক পদ্ধতি গ্রহণ করা। এই উপাদান গুলিকে একত্রে করে সুস্থায়ী কৃষির জন্যে নিজের সম্পদগুলিকে চিনে নিয়ে  যেগুলি নেই সেগুলির উপস্থিতি তৈরী করতে হবে অর্থাৎ সুস্থায়ী কৃষি করতে হলে জৈব বা প্রাকৃতিক সম্পদকে ব্যবহার করতে হবে।  চাষের পর অবশিষ্ট অংশকে সারের কাজে ব্যবহার করতে হবে বাড়িতে প্রক্রিয়াকরণের মাধ্যমে। মাটির উর্বরতা শক্তি বৃদ্ধির জন্যে  কেঁচো সার, তরল জৈব সার, সবুজ সার, জীবাণু সার ইত্যাদি এবং  জৈব কীটবিতাড়ক এর জন্যে গন্ধক ও তিতা জাতীয় গাছের বৃদ্ধি করতে হবে সেই সাথে পশুপালনের উপর জোর দিতে হবে। মাটি ও জলের গুণমান সম্পর্কে ওয়াকিবহাল হয়ে এবং তার সঠিক ব্যবস্থাপনা করে চাষ করলে কৃষিকে টেকসই করে তােলা যায়।

    আরও দেখুন - কেঁচো সার তৈরী পদ্ধতি

    4.জৈব সারের গুরুত্ব -

    জীবিত উৎস  থেকে উৎপন্ন সারকে আমরা জৈব সার বলি। আরও বিশদভাবে বললে, প্রাণির বিষ্ঠা ও মূত্র বা সরাসরিভাবে প্রাণি বা উদ্ভিদের শরীর বা শরীরের অংশ থেকে যে সার তৈরি হয় তাকে জৈব সার বলা হয়। সুস্থায়ী কৃষি মানে ফসল ও জমির দীর্ঘ সূত্রতা অর্থাৎ যা প্রয়োগের ফলে জমি ও ফসলের স্থায়ী ক্ষমতা বৃদ্ধি পাবে যেমন ফসল সংগ্রহের পর কেমিক্যাল ব্যবহৃত ফসলের তুলনায় বেশি সময় পর্যন্ত সতেজ থাকবে এবং খাদ্য হিসাবে গ্রহণের পরেও শরীরে রোগ ব্যাধি কম হওয়ার ফলে মানুষের জীবন ধারণ ক্ষমতা বেড়ে  যাবে। 

     জমিতে উর্বরা শক্তি বৃদ্ধি পাবে অসংখ্য উপকারী জীবাণু ও কেঁচোর সংখ্যা বৃদ্ধি পাবে ফলে ফসল বেড়ে উঠার প্রয়জনীয় উপাদান গুলি বৃদ্ধি পাবে ,বাইরে থেকে আলাদা কৃত্রিম কিছুর প্রয়জন হবে না ,এর ফলে বাস্তুতন্ত্র রক্ষা পাবে এবং রোগ পোকার আক্রমণ কমবে। বাস্তুতন্ত্র ঠিক থাকলে উপকারী পাখি পোকা অপকারী পোকামাকড়কে খেয়ে ফসলকে সুরক্ষিত রাখে ও পরাগায়নের ফলে ফুলন বৃদ্ধি পায়। তাই জৈব সারের গুরত্ব অপরিসীম চাষের ক্ষেত্রে। 

    উদাহরণ হিসাবে কয়েকটি জৈব সার যেমন গােবর বা গােমূত্র ও প্রকৃতি থেকে প্রাপ্ত উপাদান দিয়ে তৈরী হচ্ছে -কেঁচো সার ,কম্পোস্ট সার ,জৈব তরল সার অমৃত পানি ,ঘনজীবামৃত ,জীবান্মৃত , ইত্যাদি। এবং কয়েকটি কীটবিতারক দ্রবণ হচ্ছে -গোমূত্র ,নিমবীজ ও নিমপাতার নির্যাস ,এবং প্রকৃতি থেকে বিভিন্ন তিতা ও গন্ধ জাতীয় পাতা দিয়ে তৈরী হচ্ছে -। ব্রহ্মাস্ত্র ,নিমাস্ত্র , অগ্নিঅস্ত্র ইত্যদি। 

    আরও দেখুন - জীবান্মৃত কিভাবে তৈরি করব ? জৈব চাষে জীবান্মৃত কিভাবে কাজ করে ? এবং এর ব্যাবহার কিভাবে হয় ?

    5.জৈব সার ও রাসায়নিক সারের পার্থক্য-

    a.জৈব সারে  প্রাপ্ত উপাদানের কার্যকারিতা ধীরে হলেও গাছের ফল ধারণ বা ফসলের স্থায়ীত্ব বেশি হয়। কিন্তু রাসায়নিক সারে প্রাপ্ত উপাদান শুরুতে বেশি হলেও জমিতে ব্যবহারের পর তার উপাদান % কমে যায় এবং কাজ করে সাময়িক সময় পর্যন্ত সেই সাথে উৎপাদিত কাঁচামালের স্থায়ীত্ব বেশিদিন হয় না। খাদ্য গ্রহণে সহজ পাচ্য নয় তাই রোগ ব্যাধি বেশি হয়। 

    b.জৈব সার ব্যবহারে ধীরে ধীরে জমির উর্বরতা শক্তি বৃদ্ধি পায় এবং জমিতে কার্বন শক্তি ,উপকারী জীবাণু থাকে যেগুলি মাটির উপাদান গুলিকে গাছে খাদ্য হিসেবে পৌঁছে দিতে সহায়তা করে। অপরদিকে রাসায়নিক সার ব্যবহারে জমির মাটি টক্সিক হয়ে যায়। ব্যবহারের পর বেশিদিন তার গুণাবলী থাকে না ফলে ধীরে ধীরে জমিতে সারের চাহিদা বাড়ে ,টক্সিক মাটি হয়ে যাওয়ার কারণে গাছ বেড়ে ওঠার শক্তি হারিয়ে ফেলে এবং বিভিন্ন রোগের আক্রমণ হয়। 

    c.জৈব ভাবে চাষ করলে গাছের খাদ্য হিসাবে যা কিছু লাগে তা সমস্ত কিছুই প্রকৃতি থেকে পাওয়া যায়।  একটু পরিশ্রম করলেই এর যোগান দেওয়া যায় এবং চাষ ব্যবসথা সুস্থায়ী হয়  কিন্তু রাসায়নিক সার বাজার থেকে ক্রয় করতে হয় এবং মূল্য বেশি ফলে লাভের পরিমান কম হয়। 

    d.জৈব পদ্ধতিতে কীটবিতারক বানিয়ে ব্যবহার করলে পোকা মরে না কিন্তু ফসলে পোকা আক্রমণ করতে পারে না ফলে উপকারী পোকা গুলো থেকে যায় যেগুলি অন্য পোকাকে ধরে খায় ,পরাগমিলন হয় ,ফুল ঝরে পড়েনা উৎপাদিত পণ্য বিষাক্ত হয় না তাই এই খাদ্য গ্রহণে মানুষের রোগ ব্যাধি হয় না। কীটবিতারক তৈরী করলে এর উপাদান সব প্রকৃতি থেকে পাওয়া যায় তাই খরচ শুন্য কিন্তু রাসায়নিক ব্যবহার করলে সমস্ত পোকা মারা যায় ,ফলে উপকারী পোকা থাকে না ,পরাগমিলন ব্যাহত হয় ,উৎপাদন কম হয়। সব কিছুই বাজার থেকে অধিক মূল্যে ক্রয় করতে হয় এবং উৎপাদিত পণ্য খাওয়ার ফলে রোগ ব্যাধি বেশি হয়। যেমন একটি তথ্য বলছে পাঞ্জাবে প্রথম সবুজ বিপ্লব ঘটেছিলো যথেষ্ট রাসায়নিকের ব্যবহার করে এর ফলাফল হিসাবে দেখা গেছে সেখানে চাষের জমি টক্সিক হয়ে গেছে ,উৎপাদন শক্তি হারিয়ে ফেলছে মাটি তাই জমির এক থেকে দু ফুট উপরিভাগ কেটে সরিয়ে দিয়ে আবার জৈব সার ব্যবহার করে চাষ করছে। অত্যাধিক কীটনাশক ব্যবহারের ফলে ক্যান্সার রোগীর সংখ্যা বেড়েছে তাই সেখানে ভাতিন্ডা থেকে বিকানের পর্যন্ত একটি ট্রেন চলে শুধু মাত্র কেন্সার রোগীর জন্যে এবং ট্রেনের নামকরণ হয়ে গেছে ক্যান্সার ট্রেন। 

    e.তাই জৈব কৃষি করলে টেকসই হয় এবং জমি ও ফসলের শক্তি বৃদ্ধি হয় মানুষের রোগ কম হয় ও খরচ খুব কম হয়।  কিন্তু রাসায়নিক ব্যবহারে এর বিপরীত সব কিছু বাজার থেকে ক্রয় করতে হয় ,জমির ও ফসলের শক্তি নষ্ট হয় ও মানুষ বড়ো বড়ো রোগের শিকার হয় অর্থাৎ সব ক্ষেত্রেই ক্ষতি। 

    f.জৈব কে সঙ্গে নিয়ে সুস্থায়ী চাষের পরিকল্পনা করলে ভবিষ্যতের খাদ্য ,ভূগর্ভস্থ জল সব কিছুই পরবর্তী প্রজন্মের জন্যে বাঁচানো সম্ভব হবে কিন্তু রাসায়নিকে সাময়ীক উৎপাদন দিলেও আগামী প্রজন্মকে এর কেউ ফল ভোগ করতে হবে ,খরচ বেশির জন্যে কৃষি থেকে সরে আসবে মানুষ এবং উৎপাদন ব্যাহত হবে ফলে খাদ্য নিরাপত্তা থাকবে না তাই আজ বিশ্বব্যাপী জৈব চাষের মাধ্যমে সুস্থায়ী চাষের পরিকল্পনা গৃহীত হচ্ছে। আমাদের দেশে তথা রাজ্যে সুস্থায়ী চাষের বিভিন্ন পরিকল্পনা গ্রহণ করে পরিবেশ বান্ধব কম খরচে কৃষি কাজ করতে সরকার বিভিন্ন সামাজিক সংগঠন কাজ করে যাচ্ছে। 

    আরও দেখুন দ্রুত কম্পোস্ট সার তৈরী পদ্ধতি

    6.সুস্থায়ী কৃষির কর্মপরিকল্পনা বা ব্যবস্থাপনা কৌশল-

    • সুস্থায়ী কৃষি এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্যে দেশে বিভিন্ন পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছে।  ভারতে জাতীয়স্তরে সুস্থায়ী কৃষিকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার লক্ষ্যে "ন্যাশনাল ফর সাসটেইনেবল এগ্রিকালচার বা নামসা শুরু করা হচ্ছিলো বর্তমানে আর এক ধাপ এগিয়ে প্রাকৃতিক কৃষি মিশন শুরু হয়েছে। পশ্চিমবঙ্গে বর্তমানে কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় ,কৃষিবিজ্ঞান কেন্দ্র ,বিভিন্ন কৃষি দপ্তর এই কৃষি বিষয়ে পরামর্শ ও প্রশিক্ষণ দিচ্ছে এবং এর কিছুটা প্রতিফলন হিসাবে এই প্রযুক্তিগুলি নিয়ে বাংলাদেশে বিভিন্ন সংগঠন ও দপ্তর গুলি কাজ করছে। তবে পশ্চিমবঙ্গে এক দশক আগে থেকে সুস্থায়ী কৃষি পরিকল্পনা বাস্তবায়নের জন্যে আনন্দধারার মহিলাদের প্রশিক্ষণ দিচ্ছে বিভিন্ন জৈব পদ্ধতি প্রয়োগ ,পশুপালন ,মৎসচাষ ইত্যাদির সুসংহত সুস্থায়ী পরিবেশ বান্ধব চাষের মাধ্যমে চাষের খরচ কমিয়ে এনে লাভের পরিমান বৃদ্ধি করা ও বিষমুক্ত খাদ্য গ্রহণের মাধ্যমে পরিবার ও পরিবেশকে সুস্থ রাখার প্রচেষ্টা। 
    • কম খরচে সুস্থায়ী কৃষিকে সম্পর্ণ করতে হলে কিছু কর্ম পরিকল্পনা গ্রহণ করে 
    •  নিজের আয়ত্তে থাকা জমি জমা ,গাছপালা ,প্রাণী ,পুকুর সব কিছুকে সম্পদ হিসেবে ভাবতে হবে। সম্পদগুলিকে সঠিকভাবে পরিকল্পনা করে ব্যবহার করলে খরচ অনেকটাই কম হবে । 
    •  চিরাচরিত পদ্ধতির সাথে সাথে নতুন প্রযুক্তির সাথে পরিচিত হতে হবে এবং প্রশিক্ষণ নিতে হবে। 
    • মাটির স্বাস্থ্য রক্ষায় বিভিন্ন পরিবেশ বান্ধব বিষয় যেমন সবুজসারের ব্যবহার। কেঁচো-সার, কম্পােস্টসারের ব্যবহার বাড়ানাে। 
    •  স্থানীয় বিভিন্ন রােগ পােকার মধ্যেকার শিকার-শিকারী সম্পর্ক বােঝা ও এই সংক্রান্ত তথ্য সংগ্রহ। করা।
    •  ধীরে, ধীরে, অজৈব রাসায়নিক সার, কীটনাশকের ব্যবহার কমিয়ে এনে পরিবশ বান্ধব ভৌত ও  জৈব ব্যবস্থা গ্রহণ করে সুস্থায়ী কৃষি ব্যবস্থা ও আয়কে নিশ্চিত করা।
    • কীটনাশক নয় কীট বিতাড়কের ব্যবহার বাড়ানাে।
    •  খাদ্য শৃঙ্খল বজায় রাখা।
    • ধীরে, ধীরে, অজৈব রাসায়নিক সারের ব্যবহার কমিয়ে উৎপাদন ও আয়  সুস্থিত রেখে জৈব ব্যবহার প্রসার ও ভবিষ্যতে রাসায়নিক সারের উপর নির্ভরতা দর করতে হবে ।
    •  একাধিক চাষ বা জীবিকার মেল বন্ধন ও নির্বিক্তিকরণ।
    •  স্থান বিশেষে সঠিক ফসল চক্র প্রবর্তন অন্তর্বর্তী ফসলের চাষ , পয়রা চাষ একাধিক ফসল  শস্য পর্যায়।
    • স্থানীয় প্রাণী, ফসল শস্য সংরক্ষণ ও তাদের বিলুপ্তি হওয়ার থেকে রক্ষা করা।
    •  এলাকার জীব ও জৈব বৈচিত্র্যকে রক্ষা করা।
    •  এ্যাজোস্পাইরিলিয়াম এবং এ্যাজোটোব্যাকটর ইত্যাদি, জীবানু সমৃদ্ধ জৈব সারের ব্যবহার ।।
    • আয় বাড়ানোর কথা ভাবলে খরচ কমানোর চিন্তা করতে হবে -তবেই প্রাকৃতিক সম্পদের ব্যবহার হবে। 
    • কৃষি ও সংশ্লিষ্ট কাজে প্রতিরোধ মূলক ব্যবস্থা নেওয়া উচিত যেমন মাটির স্বাস্থ রক্ষা, সঠিক বীজ শোধন ও বীজ বাছাই ,পুকুরে জল জল শোধন ,সঠিক জাত নির্বাচন করে প্রাণী পালন ও প্রাণীদের  নিয়মিত প্রতিষেধক ব্যবস্থা করা। 
    • রোগ পোকা লাভা বা প্রাণীদের /মাছের রোগ বিসুখ হলে অর্থব্যয়ের আগে তাদের যত্ন এবং লক্ষ্য রাখলে অতিরিক্ত খরচ হবে না। 
    • পরিবেশ বান্ধব ব্যবস্থা গ্রহণ করে জীবিকাকে আরও সুস্থায়ী করতে হবে যেমন জৈব সারের ব্যবহার বাড়ানো ,কীটবিতারক এর ব্যবহার বাড়ানো ভূগর্ভস্থ জলের ব্যবহার কমানো ,সঠিক প্রজাতি ও ফসল নির্বাচন করা ,দেশীয় বীজ সংরক্ষণ ও ব্যবহার বাড়াতে হবে।  জৈব কৃষিতে দেশি বীজ যত ব্যবহার হবে উৎপাদন দ্বিগুন হবে বর্তমান বিভিন্ন জৈব জীবাণু সারের প্রয়োগে। 
    • পরিবারের শিক্ষিত ছেলে মেয়েদের কৃষি বিষয়ক উন্নত প্রযুক্তি প্রশিক্ষণে সামিল করতে হবে যাতে তারা কৃষি ও সংশ্লিষ্ট জীবিকার উন্নত প্রযুক্তি প্রসার করতে সফল হয়। 

    • মিশ্র ফসল ব্যবহার করতে ফাঁদ ফসল হিসাবে যেমন টমেটো ,লঙ্কা চাষ করলে চারিদিক দিয়ে ভুট্টা চাষ করতে হবে, এতে পোকা রোধী বেড়া হিসাবে কাজ করে।  বেগুন চাষ করলে জমিতে রসুন পেঁয়াজ ,গাঁদাফুলের চাষ করা কারণ এটি মৃত্তিকা জনিত রোগে বেশি আক্রান্ত হয়। 
    • জমিতে ডাল চাষ একবার অন্তত করতে হবে। এর জন্যে পয়রা পদ্ধতি গ্রহণ করা যেতে পারে যেটি আগে অনেকেই করতো ধান কাটার আগে ডাল ,মোটর ,ইত্যাদি ছড়িয়ে দিলে বিনা চাষে হতো। লাভ জমিতে রাইবোজিয়াম বৃদ্ধি পাবে সেই সাথে ডাল এর ছোবড়া দিয়ে বিভিন্ন জীবাণু সার তৈরী করা যাবে। 
    • পশু পালনে ঝোক দিতে হবে ,পশুর খাদ্য নিশ্চিত করতে হবে। 
    • জমিতে সবুজ সারের ব্যবহার বাড়াতে হবে যেমন ধঞ্চে ,এজলা ইত্যাদি। 
    • জমির আলে মাঝে নিমগাছ লাগাতে হবে এর ফলে মাটিতে পড়লে তা পচে গিয়ে নিমাটোড ও অন্যান্য উপকারী ব্যাকটেরিয়া রোধে কাজ করবে এবং পাতা দিয়ে দ্রবণ তৈরী করে ব্যবহার করলে কিতাবিতারক এর কাজ হবে। 
    •  চাষে আগাছা নাশক ব্যবহার বন্ধ করে ফসল উচ্ছিষ্ট বা খড় দিয়ে মালচিং করতে হবে। এর ফলে মাটির আদ্রতা ঠিক হবে ,অণুজীবের সংখ্যা বাড়বে ,ঘাস জন্মাবে না এবং অবশেষে জমির কার্বন শক্তি বৃদ্ধি হবে। 
    • পোকার চরিত্র অনুযায়ী কিছু কিছু পোকা নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে ফাঁদ হিসবে ফেরোমোন  ট্রাপ ,আলোক ফাঁদ ব্যবহার করে পোকা নিয়ন্ত্রণ করা উচিত। 
    • যেমন কিছু পোকা আছে যারা গন্ধক পোকা তারা বিপরীত হরমোনের প্রতি আকৃষ্ট হয়  মাছি পোকা এবং শ্যামা পোকা ,কারেন্ট পোকা এঁরা আলোর প্রতি বেশি আকৃষ্ট হয় তাই রাতে আগুন জ্বালিয়ে বা সম্ভব হলে লাইট জ্বালিয়ে নিচে জল রেখে পোকা নিয়ন্ত্রণ করা যায়। 
    আরও দেখুন - জৈব চাষে রোগ পোকা নিয়ন্ত্রণে সবচয়ে ভালো 16 টি সহজ ও পরিবেশমুখী কীটনাশক , ছত্রাক নাশক টোটকা

    7.মতামত -

    পরিবেশ এবং  জীবিকার মেলবন্ধনের প্রয়োজনীয়তা আজ বিজ্ঞানীরা মেনে নিয়েছেন তাই তারা কৃষিকে সুস্থায়ী বা টেকসই করার লক্ষ্যে কৃষিতে গবেষণা সফল  জৈব সারের ব্যবহার সম্পর্কে প্রচার করছেন এবং প্রযুক্তি সংযোগ করছেন এছাড়াও বহু কৃষক অনেকদিন আগে থেকে টেকসই প্রাকৃতিক পরিবেশ বান্ধব কৃষি করে আসছিলেন এবং বর্তমানে তারা তাদের উদ্ভাবিত সফল কৌশল অন্যান্য কৃষকদের উৎসাহিত করছে যেমন পদ্যশ্রী প্রাপ্ত সুভাষ পালকর।  তিনি ভারত সরকারের প্রাকৃতিক টেকসই কৃষি ব্র্যান্ড হয়ে কাজ করছে। বিভিন্ন সংগঠন এই বিষয়ে কাজ করছে বহুদিন দিন থেকে যেমন সুন্দরবন অঞ্চল এবং তার আসে পাসে কয়েকটি জেলাতে দিশা সমাজসেবা সংগঠন দুই  দশকের বেশি সময়  ধরে কাজ করছে পরিবেশ মুখী কৃষি ও জীবিকার মান উন্নয়নে। লোকোকল্যাণ পরিষদ সংগঠনও একইভাবে পরিবেশ মুখী টেকসই কৃষির উপরে কাজ করে যাচ্ছে দিনাজপুর মালদা ইত্যাদি জেলাগুলিতে। 

    সরকারি ভাবে টেকসই কৃষির জন্যে জৈব চাষের বিভিন্ন কর্মশালা আয়োজন হচ্ছে। বিশেষ করে নারীদের সুস্থায়ী কৃষিতে নেতৃত্ব দেওয়ার জন্যে দলগত ভাবে প্রশিক্ষণ দিচ্ছে এবং অনেকেই সেখান থেকে শিখে আবার অন্যকে প্রশিক্ষণ দিচ্ছে প্রশিক্ষক হয়ে। কৃষিকে সুস্থায়ী করে তুলতে জৈব চাষের প্রসারের জন্যে ভারত সরকার জৈব ক্লাস্টার তৈরির প্রকল্প চালু করেছে। ওয়ার্ল্ড ব্যাংক প্রগতিশীল দেশগুলিতে সুস্থায়ী কৃষি স্থাপনের জন্যে জৈব সার তৈরী ও ইত্যাদি প্রাকৃতিক উপাদানের মাধ্যমে পরিবারের আয় বৃদ্ধির জন্যে অর্থায়ন করছে। 


    জীবিকার মান উন্নয়ন করার জন্যে কৃষিকে সুস্থায়ী করতে হলে কৃষি থেকে অব্যবহৃত উচ্ছিষ্ট বস্তু ,দেশি প্রজাতির একটি গরু ,ভেষজ উদ্ভিদ ইত্যাদির সংমিশ্রণ ঘটিয়ে জৈব সারের ব্যবহার বাড়াতে হবে এবং সময়ে মাটি পরীক্ষা করে গাছের খাদ্য পুষ্টির উপস্থিতি বুঝতে হবে এবং একটি এলাকায় শুধু নিজে নয় চেষ্টা করতে হবে অন্যকে এই চাষে উদ্বুদ্ধ করতে তবেই জৈব সারের সঠিক ব্যবহারে জৈব চাষ  সুস্থায়ী পরিবেশবান্ধব টেকসই কৃষি হয়ে উঠবে।  

    আরও দেখুন - নিমাস্ত্র কিভাবে তৈরি করে ? ব্রম্মাস্ত্র কিটনাশক কিভাবে তৈরি করে ?

    FAQ(প্রায়ই জিজ্ঞাসিত প্রশ্নোত্তর )

     1.সাস্টেনেবল  এগ্রিকালচার কিংবা টেকসই বা সুস্থায়ী কৃষি বলতে কী বুঝি?

    মাটি, জল, আঞ্চলিক প্রাণসম্পদ নষ্ট না করে, প্রকৃতির স্বাভাবিক শক্তিকে ব্যবহার করে এবং তাকেই আরও মজবুত করে যে চাষবাস বা পশুপালন তাকেই বলা হয় সুস্থায়ী কৃষি। সুস্থায়ী কৃষিতে কৃষক প্রধানত তাঁর খামারে এবং আশপাশের প্রকৃতি-পরিবেশে পাওয়া যায় এমন উপাদান ব্যবহার করে চাষবাস করেন ফলে তাঁর খরচা খুব কম থাকে। এর ফলে চাষ লাভজনক হয় এবং এই কারণেও এই চাষ সুস্থায়ী বা টেকসই।

    2.জৈব সার বলতে কী বুঝি? জৈব সারের কয়েকটি উদাহরণ।

     জীবিত উৎস থেকে উৎপন্ন সারকে আমরা জৈব সার বলি। আরও বিশদভাবে বললে, প্রাণির বিষ্ঠা ও মূত্র বা সরাসরিভাবে প্রাণি বা উদ্ভিদের শরীর বা শরীরের অংশ থেকে যে সার তৈরি হয় তাকে জৈব সার বলা হয়। এর উলটো দিকে রয়েছে খনিজ পদার্থ থেকে তৈরি কারখানায় রাসায়নিক পদ্ধতিতে তৈরি সার যেমন কিনা বাজারে প্রাপ্ত ইউরিয়া বা ডিএপি।

    উদাহরণ -গোবর গোমূত্র থেকে তৈরী জীবান্মৃত ,মিরাক্কেল বা অমৃতজল ,তরল সার ,কেঁচো সার ,কম্পোস্ট সার ,সবুজ সার ইত্যাদি। 

    3.নাইট্রোজেন ঘটিত জৈব সারের নাম কি ?

    সবুজ সার ,এজলা ,ধঞ্চে , ঘন জীবান্মৃত  ইত্যাদি। 

    4.জৈব সার ব্যবহারের উপকারিতা কি ?

    মাটির উর্বরতা বৃদ্ধি করে মাটিতে অনুখাদ্য , উপকারী জীবাণু ,কেঁচোর সংখ্যা বৃদ্ধি করে ,কার্বন শক্তি বৃদ্ধি করে , গাছ তার প্রয়োজন অনুসারে যে খাদ্য গ্রহণ করে তা সবকিছু মাটিতে উপস্থিতি পাওয়া যায়। কাঁচা ফসলের টেকসই বেড়ে যায় ,খাদ্যের পুষ্টিগুণ বজায় থাকে এবং সুস্বাদু হয় ও এর বাজারে চাহিদা খুব।  

    তথ্য সূত্র - 

    1.ন্যাশনাল মিশন ফর সাস্টেনেবল এগ্রিকালচার গভর্নমেন্ট অফ ইন্ডিয়া । 

    2.সুসংহত সুস্থায়ী চাষ ব্যবস্থাপনা (CMSA ) আনন্দধারা -পশ্চিমবঙ্গ সরকার 

    3.দিশা ফাউন্ডেশন কলকাতা 


    আরও দেখুন - 

    একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

    0মন্তব্যসমূহ

    একটি মন্তব্য পোস্ট করুন (0)