কেঁচো সার তৈরী পদ্ধতি ?

Didibhai Agrofarm
6

কেঁচো সার তৈরী পদ্ধতি ?

কেঁচো সার এর গুরুত্ব -

গাছ বেড়ে ওঠার জন্যে মাটি থেকে যে ১৬ টি অনুখাদ্য গ্রহণ করে থাকে তার মধ্যে কেঁচো সারেই থাকে ১০ টি উপাদান। চাষ কার্য করতে গিয়ে হয়তো অনেকেই ৩-৪ টি খাদ্য ছাড়া বাকি গুলো দেওয়া হয় না কিন্তু কেঁচো সার প্রয়োগ করলে বাকি অনুখাদ্য গুলি গাছ পেয়ে যাবে। কেঁচো মাটি খেয়ে যে মূল তৈরী করে তাতে সেই জমির মাটির থেকে ৫ থেকে ৬ গুন্ নাইট্রোজেন , ফসফেট ৫ থেকে ৬ গুন্ এবং ১০ থেকে ১২ গুন্ পটাশ থাকে এবং জমির মাটির তুলনায় কেঁচো মল মাটিতে ৭০০ থেকে ১০০০ গুন্ উপকারী জীবাণু থাকে যা অল্প সময়ে জৈব পদার্থ কে হিউমাস এ পরিবর্তন করে। নিয়মিত কেঁচো সার প্রয়োগ এবং রাসায়নিক কমিয়ে আনার  ফলে একটা সময় কেঁচোর সংখ্যা এতটা পরিমান বৃদ্ধি পাবে যে সমস্ত মাটি কেঁচো মল দ্বারা গঠিত হবে এর  ফলে মাটিতে বাতাস চলাচল করতে পারবে ,জল ধারণ ক্ষমতা বাড়বে এবং বাইরে থেকে খাদ্য প্রয়োগের প্রয়োজনীয়তা কমে যাবে। এর গুনাগুনের জন্যে বিজ্ঞানী এরিস্টটল কেঁচোকে পৃথিবীর পুষ্টিকনালী যন্ত্র বলেছিলেন। 

দেখা গেছে  জৈব সার প্রয়োগ করলে এক বিঘা জমিতে ৭০ হাজার থেকে ৮০ লক্ষ্য কেঁচো পাওয়া যেতে পারে।  আবার এটাও দেখা গেছে যে জমিতে প্রচুর পরিমানে রাসায়নিক সার এবং কীটনাশক ব্যবহার করা হয় সেই জমিতে কেঁচো থাকে না কিন্তু কয়েক বছর রাসায়নিক ব্যবহার বন্ধ রাখলে আবার কেঁচো ফিরে  আসতে থাকে অর্থাৎ কেঁচোর পরিবেশ বজায় রাখতে হলে রাসায়নিক এর পরিমান ধীরে ধীরে কমিয়ে শুন্যে নিয়ে আসতে হবে এবং কেঁচো সার এর ব্যবহার বাড়িয়ে তুলে জমিতে  কেঁচোর আধিক্য বাড়িয়ে জমির উর্বরতা বাড়িয়ে তুলতে হবে ।  বিজ্ঞানী চার্লস ডারউইন এর মতে কেঁচো পৃথিবীর বুকে উর্বর মাটি তৈরী করার ক্ষেত্রে প্রধান ভূমিকা পালন করে এবং তিনি প্রথম কেঁচোর গুরত্ব এবং ভুমিকার কথা প্রকাশ করেন। 

১।  কেঁচোর জাত এবং উপযুক্ত পরিবেশ -

কেঁচো সার উৎপাদন করতে হলে কেঁচোর সঠিক জাত নির্বাচন এবং উপযুক্ত পরিবেশ এই দুটো জানা আবশ্যিক।  কেঁচো নির্বাচন করতে হবে মূলত যে কেঁচো বেশি খায় এবং বেশি মলত্যাগ করে অর্থাৎ কম সময়ে কঠিন বর্জ্য গুলিকে খেয়ে মলত্যাগ করে এবং আবহাওয়ার তারতম্য সহ্য করতে পারে  এই ধরণের কেঁচো সংগ্রহ করতে হবে। কেঁচো সাধারণত নিজের দেহ ওজন পিছু ১০০ থেকে ৩০০ মিলিগ্রাম খাদ্য দৈনিক খায়।  কেঁচো গুলি সাধারণত লালচে বাদামি  হয় এবং দেশি বিদেশী দুই প্রজাতির কেঁচোই পাওয়া যায়।  দেশি কেঁচো যেগুলো হয় ১৫ থেকে ২০ সেন্টিমিটার হয় ও মাটির উপরে থাকতে ভালো বাসে এবং কলাগছেও দেখা যায়।  আর একটি বিদেশী কেঁচো হল আইসিনিয়া ফয়টিডা যা এখন বিভিন্ন জায়গায় ব্যবসায়ীক ভাবে কেঁচো সার উৎপাদনে ব্যবহার করা হচ্ছে।  তবে যদি কেঁচো না পাওয়া যায় তবে নিজেই কেঁচো উৎপাদন করে নেওয়া যেতে পারে এর জন্যে যেখানে দু একটি কেঁচো দেখা যাবে এমন জায়গায় গুড় এবং কাঁচা গোবর  সমপরিমাণ ৫০০ গ্রাম হলে ১ লিটার জলে  মিশিয়ে নিয়ে ঢেলে দিয়ে তার উপর চটের ভেজা বস্তা দিয়ে ঢেকে দিতে হবে এবং তার উপর কিছু খড় বা আবর্জনা দিয়ে রেখে দিলে ৭ দিন পর বস্তা সরালে অসংখ স্থানীয় কেঁচো পাওয়া যাবে , এর পর সেই কেঁচো নিয়ে সার বানানোর কেঁচো পিটে দেওয়া যাবে।  

কেঁচো মূলত ১৫ ডিগ্রি থেকে ৩০ ডিগ্রি তাপমাত্রা এবং ৬০ -৭০% আদ্রতা ও মাটির PH ৭ থেকে ৮.৫ এ থাকতে পছন্দ করে। 

আরোও দেখুন -জীবান্মৃত কিভাবে তৈরি করব ? জৈব চাষে জীবান্মৃত কিভাবে কাজ করে ? এবং এর ব্যাবহার কিভাবে হয় ? দিদিভাই এগ্রোফার্ম

২। সার তৈরী পদ্ধতি -

কেঁচো সার মূলত ৩ টি পদ্ধতি করা যেতে পারে -

ক। মাটিতে গর্ত করে -

খ।  ট্যাংক বা খাঁচা তৈরী করে -

গ।  বেড তৈরী করে-

নিন্মে আলোচনা করা হল ৩ টি পদ্ধতি 

ক। মাটিতে গর্ত করে -

মাটিতে গর্ত করে করলে ৩ ফুট চওড়া ৬   ফুট লম্বা এবং ২.৫ ফুট গভীরতা করে গর্ত করতে হবে এবং নিচে প্লাষ্টিক বিছিয়ে দিয়ে মাটি দিয়ে চারিদিক বেঁধে দিতে হবে যেন বাহিরের জল ভেতরে প্রবেশ না করতে পারে।  উপরে শেড দিতে হবে বৃষ্টির জল যেন না ঢুকে এবং লাল পিঁপড়ের হাত থেকে কেঁচোকে বাঁচানোর জন্যে চারিদিক দিয়ে মাঝে মাঝে হলুদ গুঁড়ো বা কেরোসিন ছাই মিশিয়ে দিতে হবে। উপরোক্ত পরিমান জায়গা তে করলে ২ মাসে ৭০০ -৮০০ কেজি কেঁচো সার পাওয়া যেতে পারে। 

সতর্কতা -

এই পদ্ধতিতে করলে নিচে পলিথিন এর উপরে পাথর বিছিয়ে দিতে হবে যেন সার নিঃসৃত জল নিচে গিয়ে জমা হতে পারে।  তবে এই পদ্ধতিতে করলে সার উৎপাদন অনেকটা দেরি হয় ভেজার আধিক্য বেশি থাকার কারণে এবং পলিথিন ফুটো হয়ে গেলে কেঁচো পালিয়ে যাবার সম্ভাবনা বেশি থাকে। 

খ।  ট্যাংক বা খাঁচা তৈরী করে -

মাটির উপরে সিমেন্ট এর ট্যাংক করা যেতে পারে ৭ ফুট লম্বা ৫ ফুট চওড়া ২.৫ ফুট গভীরতা এবং ট্যাংক এর মাঝ খানে লম্বা ভাবে একটি দেওয়াল দিতে হবে ছিদ্র রেখে যেন এক দিক খাওয়া হয়ে গেলে আর দিকে কেঁচো চলে যেতে পারে ফলে সার সংগ্রহ করতে সুবিধা হয় এর জন্যে দুটি চেম্বার একবারে ভর্তি না করে একটি তে কেঁচো ছাড়া হয়ে গেলে তার ১৫ দিন পর আর একটি ট্যাংক বর্জ দিয়ে ভর্তি  করা শুরু করে দিতে  হবে। নিচে একদিকে ঢাল রেখে ছিদ্র রাখতে হবে যেন সার নিঃসৃত জল বাহিরে বের হয়ে যেতে পারে এবং সেগুলিকে ধরে রাখার ব্যবস্থা করে ব্যবহার করলে সব্জি বাগানে  স্প্রে করে তাহলে গাছের বৃদ্ধি ভালো ঘটে এগুলিকে ভার্মি ওয়াশ বলে।   

খরচ কম করতে চাইলে একই মাপের বাসের খাঁচা তৈরী করে নিচে পলিথিন দিতে হবে এবং ভেতর দিক দিয়ে সিনথেটিক সারি দিয়ে চারিদিক ঘিরে দিতে হবে এতে বাহিরে বের হবে না কেঁচো এছাড়াও এখন বাজারে রেডিমেড পলিথিন মজবুত একই মাপের ব্যাগ পাওয়া যায় তাতেও সার তৈরী করা যায়।  তবে সব ক্ষেত্রেই উপরে শেড দিতে হবে যেন বৃষ্টির জল না পরে। 

আরও দেখুন  ঘনজীবামৃত জৈব সার তৈরি পধতি

গ।  বেড তৈরী করে-

কম খরচে অধিক উৎপাদন এর জন্যে নিচে পলিথিন বিছিয়ে বা মেঝে পাকা করে তাতে সার তৈরির বর্জ দিয়ে  ১ মিটার চওড়া ও ১.৫ ফুট উঁচু করে লম্বা যতদূর জায়গা অনুযায়ী সম্ভব বেড বা উচঁচু স্তূপ  করা যেতে পারে।  কেঁচো ছাড়া হয়ে গেলো তার পাশে একই ভাবে আর একটি বেড তৈরী করতে হবে যেন কেঁচোর খাওয়া শেষ হয়ে গেলে নতুন বেডে চলে পারে।  যদি একসাথে অনেক গুলি বেড নিয়ে একবারে শুরু করা হয় তবে একটি বেড এর পর ৪ ফুট ফাঁকা রেখে আর একটি বেড তৈরী করতে হবে এবং ওই ফাঁকা জায়গা গুলোতে ১৫ দিন পর বর্জ দিয়ে ভরতে হবে এবং এই ভাবেই উল্টো পাল্টা করে কেঁচো সার তৈরির প্রক্রিয়া চলতে থাকবে। 

সার তৈরির জন্যে যে বর্জ মিশ্রণ গোবর দেওয়া হবে তার উপর ৩-৪ দিনের শিকড় বিহীন  শুকনো কুচুরিপানা  বা খড় দিয়ে ঢেকে দিতে হবে এবং নিয়মিত জল স্প্রে করতে হবে যেন বর্জ্যে আদ্রতা ৬০-৭০% বজায় থাকে এর ফলে ঠান্ডা থাকবে এবং কেঁচো পালাবে না ও সব খেয়ে ফেলার কারণে সার এর গুনাগুন ভালো হবে। 

এই তিনটি পদ্ধতি ছাড়াও যারা বাড়িতে বাগানের জন্যে যারা করতে চান তারা এক মিটার ব্যাস এর সিমেন্ট এর রিং এ করতে পারেন। 

৩।  সার তৈরির উপকরণ -

সার তৈরির জন্যে বিভিন্ন উপকরণ ব্যবহার করা যেতে পারে  তবে একটি বিষয় লক্ষ্য রাখতে হবে কেঁচো ছাড়ার সময় বা পরে গ্যাস উৎপন্ন না হয় , গ্যাস উৎপন্ন হলে তাপ উতপন্ন হয় তাহলে কেঁচো থাকবে না তাই সার তরীর জন্যে যে বর্জ সংগ্রহ করা হবে তার গ্যাস বের করে দিতে  হবে।  শুধু গোবর দিয়ে করলে গোবর কে আগে ছড়িয়ে দিয়ে খলা জায়গায় উলট পালট করে  রাখতে হবে ৭ দিন এর পর ব্যবহার করতে হবে এবং যদি কাঁচা আবর্জনা এবং গোবর মিশ্রিত করে করা হয় তাহলে সব কিছু একত্রে মিশিয়ে উঁচু ঢিপ করে রেখে দিতে হবে ৩০ দিন এর পর সেগুলি ছড়িয়ে দিয়ে গ্যাস বের করে সার প্রস্তুতের জন্যে ব্যবহার করতে হবে। 

একটি পদ্ধতি হল শুধু গোবর দিয়ে উপরে কুচুরিপানা বা খড় দিয়ে ঢেকে দিয়ে করতে হবে।  

দ্বিতীয় পদ্ধতি হল ১০% মাটি ২০% কাঁচা জৈব বস্তু যেমন আগাছা ,কুচুরিপানা শেকড় বাদ দিয়ে ,৩০%শুকনো খড় কুটো যেমন ধান ,গম, ডাল এর ভুসি ও খড় ,৪০% গোবর বা পশুপাখির মল মূত্র একত্রে মিশিয়ে জল দিয়ে ভিজিয়ে উচু ঢিপ করে রেখে উপরে কাদা দিয়ে লেপে এক মাস রেখে দিয়ে এর পর তা একদিন ছড়িয়ে দিয়ে গ্যাস বের করার জন্যে  উল্টে পাল্টে দিয়ে রেখে দিতে হবে। 

আরও দেখুন  জৈব চাষে রোগ পোকা নিয়ন্ত্রণে সবচয়ে ভালো 16 টি সহজ ও পরিবেশমুখী কীটনাশক , ছত্রাক নাশক টোটকা

৪।  কেঁচো সার এর ব্যবহার এবং উপযোগিতা -

কেঁচো সার যেকোনো ফসলের এবং গাছের খাদ্য যোগানের  জন্যে ব্যবহার করা যেতে পারে।  ফল চাষ ,যে কোনো ধরণের নার্সারী ,গাছের কলম তৈরী ,সবজি এবং গুদামজাত যেকোনো ফসল উৎপাদন করতে ব্যবহার করা যেতে পারে।  এই সার ব্যাবহার করলে গাছের ১৬ টি খাদ্য চাহিদার ১০ টি উপাদান পূর্ণ হবে এবং মাটি উর্বর হবে ফলে উৎপাদন বৃদ্ধি পাবে।  

 ২ লক্ষ্য কেঁচো  ২৪০ কুইন্টাল জৈব বর্জ্য পদার্থকে ২৫ দিনে পচানোর  মাধ্যমে সার এ পরিণত করতে পারে।  কেঁচো সার ব্যবহার করলে অব্যবহৃত জমির তুলনায় কেঁচোসার ব্যবহৃত জমিতে গাছের গ্রহণ যোগ্য নাইট্রোজেন ৫ গুন্ , পটাশ ১০-১২ গুন্ ,ফসফরাস ৭ গুন্ এবং ২ গুন্ বেশি ম্যাগনেসিয়াম ,ক্যালসিয়াম পাওয়া যায় এছাড়াও আরোও ৫ টি অনুখাদ্য পাওয়া যায়।  এই সার ব্যহার করলে গাছের রোগ প্রতিরোধ শক্তি বৃদ্ধি হয়।  উদ্বৃত্ত কেঁচো হাস মুরগির খাদ্য হিসেবে ব্যবহার করা যায় তাছাড়াও সার থেকে নিঃসৃত জল যেটিকে ভার্মিওয়াশ বলে সেটি শাকসবজি ,ফল গাছে ব্যবহার করলে গাছের পাতা সতেজ হয় এবং বৃদ্ধি ভালো হয়।  

৫।  কেঁচো সার এর ব্যবসা এবং দাম -

 কেঁচো সার ব্যবসায়ীক আকারে করে এখন অনেকেই অনেক টাকা উপার্জন করছে এবং কর্মসংস্থান এর সৃষ্টি হচ্ছে। গ্রামে শহরে পুরুষ নারী অনেকেই এই ব্যবসার মাধ্যমে নিজেকে সাবলম্বী করেছেন।  অনেক নারী উদ্যোক্তা কেঁচোসার এর ব্যবসা স্থাপন করে লক্ষ্য লক্ষ্য টাকা ইনকাম করছেন।  এই ব্যবসা করা সহজ বাড়িতেই করা যায় এবং বাজার মূল্য ভালো।  দিনকে দিনকে কেঁচো সার এর ব্যবহার বাড়ছে ফলে আগামীদিনের জন্যে এই ব্যবসায় অধিক সাফল্য আসবে । 

কেঁচো সার বিভিন্ন ভাবে বিক্রয় হয়ে থাকে গ্রামাঞ্চলে এর প্রতি ৮ থেকে ১০ টাকা তে বিক্রয় হয়। ডিজিটাল ব্যবসায় অংশগ্রহণ করলে যেমন ফ্লিপকার্ট ,আমাজন ,ইন্ডিয়ামার্ট প্রভৃতির মাধ্যমে বিক্রয় করলে অনেক বেশি মূল্যে বিক্রয় হয় ফলে কেঁচো সার এর ব্যবসা স্থাপন করলে নিজের অর্থনৈতিক অবস্থার পরিবর্তন করা যাবে অনেকের কর্মসংস্থান এর মধ্য  দিয়ে।  


আরও দেখুন - 

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

6মন্তব্যসমূহ

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন