মাছ ও হাঁসের যৌথ খামার তৈরী পদ্ধতি

Didibhai Agrofarm
0
মাছ ও হাঁসের যৌথ খামার তৈরী পদ্ধতি

মাছের সাথে হাসপালন কে এক কোথায় সমন্বিত বা সুসংহত মৎস্য চাষ বলে আগে জেনে নেওয়া যাক সেটি কি ?

সমন্বিত বা সুসংহত মাছ চাষ (Integrated Fish Farming)

যখন একাধিক চাষ পদ্ধতি একই খামার ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে এক পদ্ধতির বর্জ্য পদার্থ অন্য পদ্ধতিতে ও ব্যবহার করে উৎপাদন বাড়ানাের ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয় তখন তাকে সমন্বিত চাষ বা ইন্টিগ্রেটেড ফার্মিং বলা হয়। মাছ চাষের সাথে যখন অন্য কোন চাষ পদ্ধতি যেমন হাঁস, মুরগী ডেয়ারীএকত্রে একই ব্যবস্থাপনায় এনে কম খরচে উৎপাদন বাড়ানাের ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয় তখন তাকে সমন্বিত মৎস্য চাষ বা সুসংহত মৎস্য চাষ এবং ইংরেজীতে ইন্টিগ্রেটেড ফিশ ফার্মিং (Integrated Fish Farming) বলে। এই ধরণের চাষের মূল ভিত্তি হল এক চাষ পদ্ধতির বর্জ্য পদার্থ অন্য চাষ পদ্ধতিতে ব্যবহার করা এবং কম খরচে উৎপাদন বাড়ানাে। শুধুমাত্র মাছ চাষে সারা বছর যা খরচ হয় তার ৬০ শতাংশ মাছের খাদ্য ও সারে ব্যয় হয়। কিন্তু মাছ চাষের সঙ্গে হাঁস, মুরগী কিংবা শূকর পালন করলে তাদের থেকে যে বর্জ্য পদার্থ বা মল পাওয়া যায় তা মাছ চাষের পুকুরে জৈব সার হিসাবে প্রয়ােগ করলে পুকুরের মাছ প্রাকৃতিক খাদ্যকণার সংখ্যা বৃদ্ধি করে, ফলে মাছের বৃদ্ধি দ্রুত হয়। এছাড়া এই সমস্ত বর্জ্য পদার্থের মধ্যে থাকা আপাচ্য খাদ্য কণাও মাছ ভক্ষণ করে। তাই এই ধরণের ফার্মিং ব্যবস্থাপনায় রাসায়নিক সার ও পরিপূরক খাদ্য ব্যবহার করা হয় না বলে চাষীকে আলাদাভাবে সার ও পরিপূরক খাদ্যের জন্য কোন ব্যয় করতে হয় না। সেই সঙ্গে হাঁস, মুরগীর ডিম ও মাংস এবং পরিণত শূকর বিক্রি করেও চাষীর আর্থিক স্বচ্ছলতার উন্নতি হয়। এই সব চাষের মধ্যে এখানে হাস এর সাথে মাছ চাষের পদ্ধতি তুলে ধরা হল যার ফলে লাভের পরিমান অনেকটা বেড়ে যায় খরচ এর পরিমান কমে গিয়ে।  

* হাঁস পালনের ফলে মাছচাষের উপকার-

১) হাঁসের মল পুকুরে সরাসরি ব্যবহৃত হয়। এই মল জৈব সারের কাজ করে পুকুরে খাদ্যকণার সংখ্যাবৃদ্ধি। করে। তাই মাছ চাষের জন্য অন্য কোন সার প্রয়ােগ করতে হয় না।'

২) মাছের পক্ষে ক্ষতিকর জলজ উদ্ভিদ ও কীট পতঙ্গ হাঁস খেয়ে পুকুরের পরিবেশঠিক রাখে।

৩)পুকুরের ধরে জমে থাকা ঘাস ,পোকা প্রভৃতি খেয়ে ফেলে  পুকুর পরিস্কার রাখে।

* মাছ চাষের ফলে হাঁসের উপকার-

 ১) হাঁসের থাকার ঘরের জন্য পুকুর পাড়ে প্রয়ােজনীয় জায়গা থাকে তাই হাঁসের জন্য অন্য কোথাও জায়গা। সংগ্রহ করতে হয় না। 

২) হাঁস মুক্তভাবে পুকুরে ঘােরাফেরা করার জায়গা পায় এবং পুকুর থেকে তাদের প্রাকৃতিক খাদ্য সংগ্রহ করতে পারে। পুকুরে এভাবে ঘােরাফেরার জন্য তাদের ব্যায়াম হয়এবং তাড়াতাড়ি বৃদ্ধি পায়। 

৩) মাছের উপজাতবস্তু অর্থাৎ ফিস মিল হাঁসের পরিপূরক খাদ্য হিসাবে ব্যবহৃত হয়।

মাছ চাষের সাথে  হাঁস পালনের পদ্ধতি

ক) মাছ উৎপাদন এর জন্যে করণীয় কাজ গুলি -

১) মাছের সাথে হাসপালন এর জন্যে সারা বছর জল থাকে এমন পুকুর হলেই ভালো। 

2।  পুকুরের চারিদিকে যদি বেশি গাছ পালা থাকে তার ডাল ছেঁটে দিতে হবে। পুকুরে যদি জলজ উদ্ভিদ  থেকে থাকে তা তুলে অপ্রয়জনীয় মাছ ও পোকা  নিধনের জন্য ২৫ পিপি এম মহুয়া খােল পুকুরে প্রয়ােগ করতে হবে। 

৩) মহুয়া খােল পুকুরে দেওয়ার ৩-৪ সপ্তাহ পরে বিঘা প্রতি ১০০০ থেকে ১৫০০  চারাপােনা ছাড়তে  হবে। পুকুরের খাদ্য সঠিকভাবে ব্যবহারের জন্য প্রতি ২০টি চারাপােনার জন্য কাতলা ৪টি, সিলভারকার্প৪টি, রুই৪টি, সাইপ্রিনাসকার্প৩টি, মৃগেল ৩টি এবং গ্রাসকার্প ২টি হলে ভাল হয়। চারাপােনা ১০ সেন্টিমিটারের উপরে হওয়া উচিত না হলে হাঁস ছােট চারাপােনা খেয়ে ফেলতে পারে। 

৪)বছরে  বিঘা  প্রতি 50 কেজি চুন প্রয়ােগ করতে হবে।  মাছ ছাড়ার আগে ২৫ কেজি দিতে হবে এবং বাকী ২৫ কেজি  ছাড়ার পর সমভাবে  ৮ কিস্তিতে সারা বছর পুকুরে প্রয়ােগ করতে হবে। 

৫) মাছের বৃদ্ধি ,তাদের কোনো রোগ ব্যাধি আছে কিনা তা দেখার জন্যে এবং পুকুরের তলায় দূষিত গ্যাস দূর করার জন্যে মাসে একবার পুকুরে জাল টানতে হবে। 

 ৬) হাঁসের মলকে জৈব সার হিসাবে ব্যবহারের জন্য দিনের বেলা হাঁসকে পুকুরে ছেড়ে দিতে হবে। পুকুরের জলে মুক্তভাবে ঘােরাফেরাকরার ফলে হাঁসের মল পুকুরের সর্বত্র সমানভাবে পড়ে পুকুরের উর্বরতা বৃদ্ধি করবে। তাছাড়া রাত্রে তারা তাদের ঘরের মধ্যে যে মল ত্যাগ করে তাও পুকুরে প্রতিদিন সকালে প্রয়ােগ করতে হবে। 

খ) হাঁস পালনের জন্য প্রয়ােজনীয় কাজ  -

১) সাধারণতঃ দুটো ভ্যারাইটির হাঁস-খাকী ক্যাম্পবেল ও ইন্ডিয়ান রানার নির্বাচন করতে পারলে ভালাে হয়। এদের মধ্যে খাকী ক্যাম্পবেল হাঁস  বাংলার আবহাওয়ায় ভালােভাবে নিজেদের মানিয়ে নিতে পারে। নাম থেকে বুঝে নিতে অসুবিধা হয় না যে এদের গায়ের রঙ খাকী, মাথা ও গলার দিক কিছুটা গাঢ়। উজ্জ্বল  সবুজ বর্ণের হয়। বড় হাঁস ২.০-২.২ কেজি ও হাঁসা ২.৫ কেজি ওজনের হয়। এরা মাত্র ২০ সপ্তাহ মল থেকে ডিম দিতে শুরু করে এবং বছরে প্রায় ৩০০টি ডিম দেয়। শুধু তাই নয়, এক একটি ডিমের ওজন ৬৫-৭৫ গ্রাম হয়ে থাকে।

২/ হাঁসের থাকার জন্যে ঘরের  দরকার। হাঁস ও মরগীর ঘর খােলামেলা হওয়া উচিত এবং ঘরে যাতে পর্যাপ্ত "তে পারে সে ব্যবস্থা করতে হবে। এদের ঘর পুকুরের উপর অথবা পুকুর পাড়ের উপরেও  করা যেতে পারে। গ্রামীণ  পরিবেশে স্বল্প খরচে  হাঁসের ঘর তৈরী করতে হলে পুকুরের উপর তৈরী করাই ভালো । ঘরটি  কত বড় হবে তা নির্ভর করে ঐ ঘরে কতগুলাে হাঁস রাখা হবে তার উপর। সাধারণত প্রতিটি হাঁসের j জন্য দেড় থেকে দই বর্গফুট  জায়গা দরকার হয়। পুকুরের  কিনারায় শক্ত বাশের বা সিমেন্ট এর খুঁটির সাহায্যে পুকুরের পাড়ের থেকে ১-২ ফুট উঁচু রেখে বাস দিয়ে ঘরের ফ্রেম করে বাসের  বাতা দিয়ে এমন ভাবে  মাচা করতে হবে যাতে এক বাতা থেকে আর এক বাতার দুরুত্ব এক সেন্টিমিটার থাকে এবং হাঁসের পা যেন এর ভেতর ঢুকে না যায়।   কেবলমাত্র এই ফাক দিয়ে হাঁসের  মল ও পরিত্যক্ত খাবার সহজেই পুকুরে পড়তে পারে। মেঝে থেকে হাঁসের  মল বা  খাবার সম্পূর্ণভাবে পুকুরে না পড়লে জল দিয়ে পরিস্কার করে দিতে হবে। মেঝে থেকে ঘরের উচ্চতা ৫-৬  ফুট হওয়া উচিত। ঘরের ছাউনি খড় দিয়ে তৈরী করলে ভালাে এতে ঘরের তাপমাত্রা ভালাে থাকে, দেওয়ালে নিচের দিক থেকে ২ ফুট পর্যন্ত কাঠ বা বাঁশের তৈরী বেড়া দিয়ে ঘিরে দিতে হয় যাতে অন্যান্য  জীবজন্তু প্রবেশ করতে না পারে। দেওয়ালের বাকী অংশ চালা পর্যন্ত আধ ইঞ্চি ফাঁকাযুক্ত তারের জাল চেরা বাঁশের বুনট দিয়ে ঘিরে দিতে হয়। এতে ঘরের মধ্যে আলাে বাতাস ঢুকবে। তবে বর্ষা বা শীতের সময় চট বা পলিথিন চাদর দিয়ে পর্দার ব্যবস্থা করতে হবে। হাঁস ঘরে ওঠার জন্য বাঁশ দিয়ে তৈরী একটা সিড়ির ব্যবস্থা রাখতে হবে। ঘরের মধ্যে মুক্ত বায়ু চলাচল করার জন্য ভেন্টিলেটারের ব্যবস্থা রাখা উচিত।

 উৎপাদন-

প্রতি হাঁস প্রত্যেকদিন ১২৫-১৫০ গ্রাম মলত্যাগ করে। এক হেকটর পুকুরে ২০০-৩০০টি হাঁস। দরকার যারা বছরে ১০,০০০-১৫,০০০ কেজি মল ত্যাগ করে, যা চক্রাকারে আবর্তিত হয়ে মাছ চাষের। খরচ কমায়। মাছ ছাড়ার ৪ মাস পরে জালের সাহায্যে বড় বড় মাছ ধরে পুনরায় চারাপােনা ছাড়তে হবে। ১২ মাস পরে পুরাে মাছ ধরে নিতে হবে। ভালাে ভাবে পরিচর্যা পেলে পরিপূরক খাদ্য না দিয়েও বছরে প্রতি হেকটরে ৩০০০-৩৫০০ কেজিমাছ উৎপাদন সম্ভব। এছাড়া প্রতি হাঁস থেকে বছরে প্রায় ২৭৫-৩০০টি ডিম এবং২.০-২.৫ কেজি মাংস পাওয়া যাবে।

আরও দেখুন 


একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0মন্তব্যসমূহ

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন (0)