আমন ধানের বীজতলা তৈরী পদ্ধতি ۔

Didibhai Agrofarm
0
আমন ধানের বীজতলা তৈরী পদ্ধতি

বাঙালির প্রধান খাদ্য শস্য হলো ধান এবং তা উৎপাদন এর জন্যে আমরা নানান কৌশল অবলম্বন করে থাকলেও আমরা যেটি প্রধান বিষয় সেই দিকটা ঠিক করে পরিচর্যা না করার ফলে  পরবর্তীতে সেই ভুল মূল জমিতে ফসলের উপর প্রভাব পরে এবং কাঙ্খিত ফলন থেকে আমরা বঞ্চিত হই | একটি গাছের সুস্থতা এবং তার ফলন প্রধানত নির্ভর করে জাত নির্বাচন ,রোগ মুক্ত বীজ এবং রোগমুক্ত সুস্থ সবল চারা যা সঠিক বয়সে মূল জমিতে লাগাতে হবে এই সব কোটি দিক ঠিক থাকলে তবেই প্রধানত গাছ ভালো ফলন দিবে পরবর্তী পর্যায়ের পরিচর্যার উপর নির্ভর করে |

সঠিক জাত নির্বাচন ۔

ধান চাষকে লাভ জনক করে তুলতে হলে প্রথম কাজ জমির ভৌগোলিক অবস্থান অনুযায়ী জমির জল ধারণ ক্ষমতা নির্ধারণ করে তার উপযোক্ত জাত নির্বাচন করা | সঠিক জাত নির্বাচন এর পাশাপাশি এটাও লক্ষ্য রাখতে হবে যে গাছের আয়ুষ্কাল কত তার উপর নির্ভর করে বীজতলাতে কত দিন চারা থাকবে | একটি গাছের আয়ুষ্কাল নির্ধারণ করবে গাছটির বাড়ন্ত সময় কতদিন সেই সাথে তার ফল আসবে কত দিনে এবং ফসল পাকবে কত দিনে ? এই সব নির্বাচন করে বুঝতে হবে তার বাড়ন্ত সময় কতদিন এই বাড়ন্ত সময় গাছকে যত বেশি সময় দেওয়া যাবে ততই গাছ পাস্ কাঠি ছাড়বে এবং ফলন বেশি দিবে আর সেই দিকটা ঠিক রাখতে হলে প্রধান যে বিষয়টি লক্ষ্য রাখতে হবে ছাড়ার শেখর যেন না ছিড়ে এবং কম বয়সে মূল জমিতে লাগানো যায় তাহলে চারা মূল জমিতে মাটি তে তারা তারি লাগবে এবং পাসকাঠি ছাড়ার সময় বেশি পাবে | সেই সাথে ধানের ফলন এর জাত অনুযায়ী সার প্রদান করতে হবে উচ্চ ফলন শীল হাইব্রিড বীজ হলে সারের পরিমান বেশি দিতে হবে  ও দেশি বীজ হলে জৈব সারের পরিমান বাড়াতে হবে |

আমন ধান সাধারণত লাগানো থেকে কেটে জমি ফাঁকা করতে প্রায় 150-170 দিন লেগে যায় ফলে অনেকেরই রবি মরসুম ধরতে অসুবিধে হয় তাই সেই দিকটা ভেবে কম সময়ের বীজ নির্বাচন করলে রবি মরসুমে সঠিক সময় রবি ফসল চাষ করতে সুবিধে হয় এবং ভালো বাজার পাওয়া যায় | 

যেখানে জল কম থাকে সেখানে অন্নদা ,পারিজাত ,বিধান 1 প্রভৃতি বীজ লাগানো যেতে পারে ,

যে জমিতে বৃষ্টি হলে জল জমে থাকে বেশি সময় ধরে সেই জমি গুলির জন্যে শতাব্দী ,ক্ষিতিশ ,এম টি ইউ 1010 যতগুলি ব্যবহার করতে পারেন ,

যে জমি গুলি নিচু এবং রবি ফসল লাগানোর সহজলভ্যতা কম সেই জমি গুলি তে বেশি সময়ের ধান 150 দিন সময়ের স্বর্ণমাসুরি , মাশুরি ,নীলাঞ্জনা ,যমুনা ইত্যাদি জাত গুলি ব্যবহার করতে পারেন এতে ফলন বেশি পাবেন এবং লাভ বেশি হবে |

বীজ তলা তৈরী ۔

আমন ধান চাষ এর জন্যে সাধারণত কৃষক বন্ধুরা বীজতলার ক্ষেত্রে তেমন গুরুত্ব দেয় না তবে আমরা বলবো  খুবই গুরুত্ব পূর্ণ বীজতলা ভালো হলে ধানের ফলন ভালো হয় | বীজতলা সাধারণত 4 টি পদ্ধতিতে করা হয়ে থাকে ۔

1. কাদা করে বেড পদ্ধতিতে 

2. শুকনো বীজতলা 

3. ট্রে পদ্ধতিতে বীজতলা যেগুলি মেশিন এর দ্বারা রোপন করা হয় 

4. প্লাস্টিক এর উপর মাদুরের মতো বিছানো বীজতলা বা  ম্যাট নার্সারি নামে পরিচিত 

এবার জেনে নেওয়া যাক বিস্তারিত ভাবে পদক্ষেপ গুলি ۔

আমন ধানের ভালো ফলন পেতে হলে উপযুক্ত জায়গা এবং উপযুক্ত জাত নির্বাচন করে যে কোনো ধরণের বীজতলায় বীজ রোপনের পূর্বে পুষ্ট বীজ নির্বাচন এর জন্যে বীজ বাছাই এবং শোধন খুব জরুরি সেটি করে নিতে হবে ۔

1. কাদা করে বেড পদ্ধতিতে --

জল নিকাশি ব্যবস্থা আছে এমন উঁচু জমি নির্বাচন করতে হবে | 1 বিঘা জমির রোঁয়া করার জন্যে সাধারণত 2 কাঠা জমির উপর বীজ ফেলতে হয় | 

বীজ ফেলার পূর্বে 4 মিটার চওড়া  বেড এবং জমি অনুযায়ী লম্বা যতটা হয় করতে হবে এবং বেড এর পাসে 1 ফুট চওড়া জল নিকাশি নালা করতে হবে যেখানে ইচ্ছে মতো জল দাঁড় করিয়ে রাখা যাবে এবং প্রয়োজনে এই জায়গা গুলি ব্যবহার করে বেড গুলির পরিচর্যা করা  যাবে |

এই পদ্ধতিতে সাধারণত 1 বিঘার জন্যে 5-6 কেজি বীজ লাগে | 
বীজতলাতে ভালোভাবে পচানো গোবর সার প্রয়োগ করতে হবে বা 20 কেজি ঘন জীবামৃত দেওয়া যেতে পারে | এছাড়াও কাঠা প্রতি 600 গ্রাম ইউরিয়া , 2 কেজি সিঙ্গেল সুপার ফসফেট ও 500 গ্রাম পটাশ ব্যবহার করতে হবে  এবং গাছের বৃদ্ধি অনুযায়ী 2 সপ্তাহ পরে আরো 500 গ্রাম ইউরিয়া দেওয়া যেতে পারে | বীজতলাতে চারার বয়স নির্ধারণ করতে পারেন ধান কত মাসের সে হিসাব করে ততো সপ্তাহ রাখতে পারেন |  বীজ ফেলার পর ছাই ছড়িয়ে দিতে পারেন তাতে চারা সতেজ হয় এবং চারা তোলার 8, দিন আগে কাঠা প্রতি 200 গ্রাম ফিপ্রনীল প্রয়োগ করলে মূল জমিতে গিয়ে মাজরা পোকার হাত থেকে  ফসল রক্ষা করার চান্স অনেকটা বেড়ে যাবে |

এবং প্রয়োজনে এই জায়গা গুলি ব্যবহার করে বেড গুলির পরিচর্যা করা  যাবে |

2. শুকনো বীজতলা ۔

উঁচু জায়গা নির্বাচন করে এক বিঘার জন্যে দু কাঠা জায়গার প্রয়োজন | শুকনো  বীজতলার ক্ষেত্রে  কাঠা প্রতি 2 কুইন্টাল গোবর দিতে হবে  এবং কাঠা প্রতি  পটাশ 400 গ্রাম দিতে হবে কাঠা প্রতি 2 কেজি সিঙ্গেল সুপার ফসফেট দিতে হবে এবং চারা লাগানোর ১০ দিন পর জল দেওয়ার পর শতকে 400 গ্রাম নাইট্রোজেন দিতে হবে এবং বেড করতে হবে 4 ফুট চওড়া এবং লম্বা যতটা হয় সাথে পাশে 1 ফুট চওড়া জল নিকাশি এবং প্রয়োজনে জল জমিয়ে রাখার জন্যে করতে হবে | 
তবে দুটি ক্ষেত্রেই জৈব তে করলে  ঘন জীবান্মৃত এবং  জীবান্মৃত দিলেই ভালো ফল পাওয়া যাবে |

যারা শ্রী বা SRI পদ্ধতির জন্যে বীজতলা করবেন  তাদের বীজ কম লাগবে বিঘা প্রতি 800 গ্রাম বীজ লাগবে এবং বীজ তলা তৈরির সময় 1 বিঘার বীজ তোলার জন্যে 4 কুইন্টাল পুরোনো গোবর সার , 25 কেজি কেঁচো সার ,400 গ্রাম ইউরিয়া সার ,500 গ্রাম ফসফেট , 200 গ্রাম পটাশ , এবং 2 কেজি নিঁম খোল মিশিয়ে 4 ফুট চওড়া এবং 20 ফুট লম্বার দুটি বেড করে জল নিকাশি ব্যবস্থা করে অংকুরিত বীজ ফেলতে হবে এবং বীজ ফেলার পর কেঁচো সার মিস্ত্রিত গুরু মাটি দিয়ে আস্তরণ দিতে হবে | নিয়মিত  সকাল বিকেল ঝাড়ি দিয়ে জল দিতে হবে এবং 10-12 দিনের মধ্যে সেই বীজ মূল জমিতে লাগানোর উপযোগী হবে | এই পদ্ধতিতে ধান চাষ করলে বিঘা প্রতি 10-15% ধান উৎপাদন বেশি হয় |

3. ট্রে পদ্ধতিতে বীজ তলা ۔

এই পদ্ধতির বীজ তলা মূলত paddy Transplanter মেশিন দিয়ে চাষ এর জন্যে করা হয় | একটি ট্রে এর সাইজ হয় সাধারণত 58 cm লম্বা এবং 28 cm চওড়া ও 1 ইঞ্চি উঁচু |  প্রতিটি ট্রে তে 100-120  গ্রাম বীজ প্রয়োজন এবং প্রতি বিঘাতে 20-22 ট্রে প্রয়োজন সেই হিসেবে করলে 2-2.5 কেজি বীজ লাগে এতে খরচ বাঁচে বীজ এর | এই পদ্ধতিতে  করলে লোকের প্রয়োজনীয়তা কম এবং সময় ও টাকা দুটোই বাঁচে এবং ইচ্ছে মতো ধানের গুছি দিয়ে দুরুত্ব নির্ধারণ করে রোঁয়া লাগানো যায় ফলে রোগ কম হয় এবং গাছের বৃদ্ধি বেশি হয় | এই পদ্ধতিতে মূলত বিভিন্ন মহিলা স্বনির্ভর দল এবং কৃষি সহায়ক সংগঠন গুলি কাজ করছেন | এর ফলে  কৃষক ও সংগঠন গুলি বেশি লাভবান হচ্ছেন | মাটি তৈরী করে নিতে হয় উপরোক্ত SRI পদ্ধতির মতো করেই এর পর মাটি গুলিকে ঝুর ঝুরে করে নিয়ে নেটিং করে ছেলে নিতে হবে  এর পর ট্রে তে মাটি ভরতে হবে 4 ভাগ এর 1 ভাগ ফাঁকা রেখে | সব হয়ে গেলে হাত দিয়ে বীজ ফেলতে হবে এমন ভাবে যেন কোনো ফাঁকা না থাকে এর জন্যে সিডার মেশিন এর সহযোগিতা নেওয়া যেতে পারে এবং বীজ ফেলার গুঁড়ো মাটি দিয়ে ঢেকে দিতে হবে এর  পর জল স্প্রে করতে হয় 3 দিন  | জায়গা কম থাকলেও বাড়িতেই সেলফ তৈরী করে অল্প জায়গায় করা যায় | শুকনো ছাড়া কাদা মাটি ভোরেও একই ভাবে এই বীজ ফেলা যেতে পারে এবং 20-22 দিনের মাথায় রোপন করা যায়  | দিনকে দিন এর জনপ্রিয়তা বেড়ে চলেছে গ্রাম থেকে গ্রামাঞ্চলে |

4. মাদুর বা ম্যাট নার্সারি ۔۔

এই বীজতলা করা হয় মূলত মেশিন এ লাগানোর জন্যে যাদের ট্রে থাকে বা বড়ো আকারে ব্যবসা করেন তাদের জন্যে | আগে মাটি প্রস্তুত করা হয় মূলত শ্রী পদ্ধতির মতোই | যেখানে বীজ ফেলা হবে সেই জায়গায় বেড করা হয় একটু উঁচু করে জল নিকাশি ব্যবস্থা রেখে তার উপর পাতলা পলিথিন বিছিয়ে দিয়ে মাটি দেওয়া হয় এবং ট্রে এর মাপে চওড়া তে একটি বা দুটি খোপ রেখে লম্বায় সুবিধা মতো 1 ইঞ্চি উচ্চতার কাঠ দিয়ে রেলিং তৈরী করে বসিয়ে তার উপর মাটি ভোরে হাত দিয়ে বা সিডার মেশিন দিয়ে অনুকুরীত বীজ ফেলে মাটি দিয়ে হালকা করে ঢেকে দিয়ে 3 দিন জল স্প্রে করে নিয়মিত নালাতে জল দেওয়া হয় ۔۔একই পদ্ধতির জন্যে কাদা ব্যবহার করেও তাতে বিজ ফেলা হয় এবং 20-22 দিন পর মেশিন দিয়ে রোপন করা হয় |

রোগ মুক্ত বীজতলা ۔

রোগ মুক্ত বীজ তোলার জন্যে  এসিফেট 0.75 গ্রাম প্রতি লিটার জলে অথবা  কাটার্ফ হাইড্রোক্লোরাইড প্রতি লিটার জলে গুলে স্প্রে করতে হবে | 

পাতায় বাদামি রং হলে ট্রাইকোলাজল 5 এম এল প্রতি লিটার জলে গুলে স্প্রে করলে ভালো ফল পাওয়া যাবে |

শোষক পোকা ,মাজরাপোকা বা টুংরো রোগ আক্রমণ করলে কাঁদানো বীজতলায় দানাদার ঔষধ কাটার্ফ হাইড্রোক্লোরাইড 4 জি প্রতি শতক এর জন্যে 150 গ্রাম প্রয়োগ করে 3 দিন জল ধরে রাখতে  হবে |

জৈব পদ্ধতিতে নিয়ন্ত্রণ করতে হলে নিয়মিত গোবর জল নির্যাস এবং নিঁম তেল ব্যবহার করলে ভালো ফল পাওয়া যাবে |

আরো দেখুন .

বর্ষার /জলদি ফুলকপি চাষ পদ্ধতি



একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0মন্তব্যসমূহ

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন (0)