বিভিন্ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের কয়েকটি প্রস্তুতি নিয়ম ও ব্যবহার প্রণালী এখানে সংযােজিত হল -
1.নিম বীজের নির্যাস :-
খােসা ছাড়ানাে নিম বীজ ৫০ গ্রাম অথবা ৭৫ গ্রাম খােসা সহ নিম বীজ এমনভাবে গুড়াে করতে হবে যেন তেল বেড়িয়ে না পড়ে। এই গুঁড়াে একটা মিহি কাপড়ে বেঁধে ১ লিটার জলে সারারাত (১২ ঘন্টা) ডুবিয়ে রেখে নিংড়ে নিতে হবে (৫% নিম বীজের নির্যাস)। এর সাথে অর্ধেক চা চামচ পরিমাণ সাবান ও এক চা চামচ তিল তেল মেশালে কার্যকারিতা বাড়ে। নিম বীজ ৩ মাসের পুরানাে হতে হবে। ৮-১০ মাসের বেশী পুরানাে। বীজ ব্যবহার করা যাবে না। বিকেলে স্প্রে করতে হয়।
2.সাবান কেরােসিনের দ্রবণ :-
২০ মি:লি: কেরােসিন তেল (৪ চা চামচ) ১ চা চামচ সাবান অর্থাৎ ৫ গ্রাম পরিমাণ (ওঁড়াে সাবান নয়) প্রতি লিটার জলে মিশিয়ে বিকেলের দিকে স্প্রে করতে হয়। অনিষ্টকারী পিপড়ে, জাব পােকা, নানাধরণের শুয়ােপােকা (কিড়া) নিয়ন্ত্রণ বা দমন হয়। প্রয়ােজণে ৭-১০ দিন অন্তর ২-৩ বার স্প্রে করতে হয়।
3. ছাই এর ব্যবহার :-
উনুনের ছাই সমানভাবে ও হালকা করে পাতায় ছড়ালে অনেক ধরণের পাতা খেকো পােকার থেকে ফসল রক্ষা করা যায়। শুকনাে ছাই বেশী কার্যকরী। এই ছাই যখন বৃষ্টিতে বা জলে ধুয়ে মাটিতে পড়ে তখন সার হিসাবেও কাজ দেয়।
4.সাবানের দ্রবণ :-
৫-৮ গ্রাম সাবান (ওঁড়াে সাবান নয়) প্রতি লিটার জলে গুলে বিকেলের দিকে স্প্রে করতে হয় (০.৫%-০.৮% দ্রবণ)। জাব পােকা, নানাধরণের ছােট বড় কিড়া, নানাধরণের বিটল নিয়ন্ত্রণ বা দমন করা যায়। সতর্কতা : ১% বেশী ঘনত্বের সাবানের দ্রবণ (১০ গ্রামের বেশী প্রতি লিটার জলে) গাছের ক্ষতি করতে পারে, গাছ মরেও যেতে পারে। সাবানের দ্রবণ প্রয়ােজনে ৭-১০ দিন অন্তর ২-৩ বার ব্যবহার করতে হবে।
5.গােমূত্রের দ্রবণ :-
দুই তিন দিনের পুরােনাে গােমূত্র চার থেকে ছয় গুণ জলের সাথে মিশিয়ে ছেকে নিয়ে স্প্রে করতে হবে। গােমূত্র ২-৩ দিন রােদে রেখে নিলে ভাল হয় এবং দুপুর রােদে স্প্রে করলে ভাল ফল পাওয়া যায়। অনেক ধরণের ছত্রাকজনিত রােগও দমন হয়। প্রায় সমস্ত ধরণের কীটশত্রু, বিশেষত পাতা খেকো বিভিন্ন শুয়ােপােকা, জাবপােকা, শােষকপােকা, নিয়ন্ত্রণ করা যায়।
6. ফসলের কৃমি জনিত রােগ :-
ফসলের ক্ষেতে বিক্ষিপ্তভাবে এক একটা গাছ যদি শুকিয়ে থাকতে দেখা যায় । তাহলে কমি জনিত রােগ হয়ে থাকতে পারে। গাছ তুলে শিকড় পরীক্ষা করলে যদি দেখা যায় শিকড়ফলে গেছে অথবা আলপিনের মাথার মত ছােট ছােট ফোলা/ গুটি হয়েছে (ডাল জাতীয় ফসলে রাইজোবিয়াম দ্বারা যেমন গুটি হয় তেমন নয়, কারণ তখন গাছ সাধারণত মরে না) তাহলে ফসলের মাঝে মাঝে গাদা গাছ ও সম্ভব হলে বসন। লাগালে উপকার হয়। মনে রাখতে হবে এর সংক্রমণ বীজের মাধ্যমেও হয়- মাটিতেও থাকে।
7.নিম খােলের ব্যবহার ;-
রােগের তীব্রতা বিচারে বিঘা প্রতি ২৫-৩০ কেজি নিম খােলের ব্যবহারের ফলে রােগ | নিরাময়ের সাথে সাথে পর্যাপ্ত জৈবসারের জোগানও হয়৷ (এতে ৩.৫৬% নাইট্রোজেন, ০.৮৩% ফসফরাস ও
১.৬৭% পটাশিয়াম ও সাথে অন্যান্য অনুসার পাওয়া যায়)। যে এলাকার এ রােগ ছড়িয়েছে- চাষের সময় নিয়মিত নিমপাতা মাটিতে মেশালেও কৃমি নিয়ন্ত্রণে থাকে৷ কৃমি নিরাময়ের সাথে সাথে মাটির অনেক ধরণের অনিষ্টকারী ছত্রাক রােগ ও জীবাণু (ব্যাকটেরিয়া) জনিত রােগ নিয়ন্ত্রণ হয় ও উপকারী জীবাণুরও বংশ বৃদ্ধি হয়। করঞ্জ খােল ও পাতাও নিমের মত কাজ করে। মহানিমও সমান কার্যকরী।
8) রেড়ির খােল ব্যবহার :-
উইপােকা দমন/নিয়ন্ত্রণ হয়: বিঘা প্রতি ৪০-৫০ কেজি ব্যবহার করা হয়। উইপােকা। নিয়ন্ত্রণের সাথে সাথে সারও সরবরাহ হয় (এতে ৫,৫-৫,৮% নাইট্রোজেন,১.৮-১.৯% ফসফরাস ও ১-১.১% পটাশিয়াম ও অন্যান্য অনুসার থাকে)।
9.নিয়মিত জৈব সারের ব্যবহার :-
কম্পােস্ট, সবুজ সার, জীবাণু সার ব্যবহারের মাধ্যমে নাইট্রোজেন ঘটিত সারের চাহিদা মেটানাের চেষ্টা করতে হবে।।নিয়মিত জৈব সার যেমন জীবান্মৃত , ঘনজীবান্মৃত , ভার্মিক কপোস্ট ,গােবর সার, কম্পােস্ট, সবুজ সার, সবুজ পাতা সার | ব্যবহারে মাটিতে বসবাসকারী অনিষ্টকারী অনেক ধরণের রােগ কম হয়। মাটির অম্লতা ও খার ভাব কমে। করঞ্জ পাতা মেশালে মাটির লবণভাবও কমে।
আরও দেখুন ঘনজীবামৃত জৈব সার তৈরি পধতি
10.নিম পাতার নির্যাস :
১৫০ গ্রাম কাঁচা নিম পাতা ৪৮ ঘন্টা ১ লিটার ঠান্ডা জলে থেঁতাে করে ভিজিয়ে তারপর ঐ। জলের সাথে চটকে মিশিয়ে ছেকে নিতে হবে। ৫ গ্রাম সাবান ঐ ছাঁকা দ্রবণে মেশাতে হবে (১৫% নিম পাতার নির্যাস)। একবার স্প্রে করার জন্য দ্রবণ বিঘা প্রতি ৯ কেজি পাতা ও ৬০-৮০ লিটার জলের প্রয়ােজন হবে। মহানিম(Perssian lilac) করঞ্জ, আতা পাতা, নিসিন্দা পাতার নির্যাস একইভাবে তৈরী হবে ও কাজ করে।
11.নিম তেলের দ্রবণ ;
৩০ মি:লি: নিম তেল ও ৫ গ্রাম সাবান প্রতি লিটার জলে মেশাতে হবে। বিকেলে স্প্রে করতে হবে (৩% নিম তেলের দ্রবণ)। প্রথমে অল্প জলে তেল ও সাবান ভাল করে ফেটিয়ে নিয়ে বাকি জল মেশাতে হবে ও তাড়াতাড়ি স্প্রে করতে হবে।
12.টাটকা গােবর জলের নির্যাস :\
১৫০ গ্রাম টাটকা গােবর প্রতি লিটার জলে গুলে একবেলা রেখে উপরের টলটলে নির্যাস ঘেঁকে নিয়ে বিকেলে স্প্রে করতে হয়। এতে নানা ধরণের ছত্রাক ও জীবানু (ব্যাক্টেরিয়া) জনিত রােগ যেমন ধানের ব্যাক্টেরিয়াল ব্লাইট, পাতায় বাদামী দাগ, খােলা পচা, গােড়া পচা রােগ, বেগুন, টমেটো,পটল ইত্যাদির পাতায় ধ্বসা রােগ ও গােড়া পচা রােগ ইত্যাদি নিয়ন্ত্রণ করা যায়। আক্রমণকারী নানা কীটশত্র যেমন দমে তেমনি সারের কাজও হয়। ১০-১২ দিন অন্তর নিয়মিত স্প্রে করলে ফলন ভাল ও বেশী দিন ধরে পাওয়া যায়।
আরও দেখুন কেঁচো সার তৈরী পদ্ধতি
13. লেনটেনা ক্যামেরা (পুটুস) পাতার নির্যাস :
১৫০ গ্রাম পাতা থেঁতাে করে প্রতি লিটার জলে ২দিন ভিজিয়ে অথবা হালকা আঁচে ১০-৩০ মিনিট ফুটিয়ে নিৰ্য্যাসটি ছেকে নিয়ে ৭-১০ দিন অন্তর স্প্রে করলে বেগুন, টমেটো ইত্যাদির সাদা মাছি, সরষে ও বাঁধাকপির ডায়মন্ড ব্যাকমথ সহ নানা শােষক ও পাতা খেকো পােকা সহজে নিয়ন্ত্রণ করা যায় যেগুলি প্রচলিত রাসায়নিক বিষে নিরাময় করা সহজ নয়। ৭-১০ দিন অন্তর ২-৩ বার বিকেলের দিকে। স্প্রে করতে হবে।
14. কুচিলার নির্যাস:
২৫ গ্রাম কুচিলা শুকনাে অবস্থায় ভেজে গুঁড়াে করে ১০ লিটার জলে ৪৮ ঘন্টা ভিজিয়ে নিৰ্যাসটি ছেকে নিয়ে বিকেলের দিকে স্প্রে করতে হয়। প্রায় সব ধরণের পাতা খেকো পােকা, কিড়া বা শুয়ােপােকা নিয়ন্ত্রণ করা যায়। কুচিলা অত্যন্ত তিতাে – তাই যে পাত্রে ভাজা করা হবে বা যার দ্বারা গুড়াে করা হবে ও ভিজানাে হবে তা। আলাদা করে রাখতে হবে বা ভাল করে সাবান দিয়ে ধুয়ে পরিষ্কার করে নিতে হবে। কুচিলা দশকর্মার দোকানে পাওয়া যায়।
15. বাের্দো মিশ্রণ বা চুন - তুতের দ্রবণ :
১০ গ্রাম পুঁতে ও ১০ গ্রাম চুন ১ লিটার জল, এই অনুপাতে মিশ্রণকে ১% বাের্দো মিশ্রণ বলে। মিশ্রণ বানানােতে বিশেষ সতর্কতা প্রয়ােজন হয় যেমন:
- সমপরিমান পুঁতে ও চুন দুটি আলাদা মাটি, কাঠ বা প্লাষ্টিক পাত্রে গুলতে হবে। কোন ধাতু নির্মিত পাত্র বা হাতা ব্যবহার করা যাবেনা।।
- এবার তৃতীয় একটি দ্বিগুণ মাপের পাত্রে চুন ও উঁতের দ্রবণ একসাথে সাবধানে ধীরে ধীরে ঢালতে হবে ও কাঠ বা অধাতব কোনও হাতা বা কাঠি দিয়ে নাড়তে হবে। মেশানাের সময় খুব গরম হয়। মেশানাে শেষ। হলে পরিমান মত ঠান্ডা জল মিশিয়ে দ্রবণটি তৈরী হয়।
- এবার একটি কাস্তে বা লােহার দন্ড বা ব্লেড ঐ মিশ্রণে চুবিয়ে দেখতে হয় তামাটে লালচে দাগ পরে কিনা। যদি দেখা যায় দাগ পড়ছে তাহলে অল্প অল্প করে চুন মেশাতে হয়। যখন দেখা যাবে লােহাতে আর দাগ। পড়ছে না তখন বুঝতে হবে দ্রবণ তৈরী সম্পূর্ণ হয়েছে। তৈরী হওয়ার সাথে সাথে স্প্রে করতে হবে। শাকসবজির, ধানের, বিশেষ করে আলুর জলদি ধবসা, নাবী ধবসা ইত্যাদি ছত্রাক জনিত রােগে খুবই কার্যকরী ও সস্তা। প্রয়ােজনে ১৫-২০ দিন অন্তর দুবার স্প্রে করা যাবে। ধানের ব্যাক্টেরিয়াল ব্লাইট, পাতায় বাদামী দাগ, খােলা পচা, গােড়া পচা রােগ, বেগুন, টমেটো,পটল ইত্যাদির পাতায় ধ্বসা রােগ ও গােড়া পচা রােগ ইত্যাদি নিয়ন্ত্রণ করা যায়।
16.জীবানুর দ্রবণ :
সিউডােমােনাস ফ্লরেসেন্স বা ট্রাইকোডারমা ভিরিডি নামের জীবাণুর দ্রবণ ব্যবহার করে বিভিন্ন ছত্রাক রােগ যেমন ধানের পাতা ঝলসা, পাতায় বাদামী ছিটে দাগ, খােলা পচা, খােলা ঝলসা রােগ, পরিবেশমুখী উপায়েই নির্মূল করা যায়।
ব্যবহারের পদ্ধতি:
বীজ শােধন
সিউডােমােনাস - প্রতি কেজি ধান বীজের জন্য ১০ গ্রাম জীবাণু ৩০০ মি:লি; জলে |গুলে ধান বীজ চার ঘন্টা ভিজিয়ে রাখা।
ট্রাইকোডারমা জীবাণু- প্রতি কেজি বীজে ৪ গ্রাম জীবাণু ও ২০ মি:লি: ঠান্ডা ভাতের। মাড় দিয়ে বীজে মাখানাে।
চাৱা শােধন :
টাইকোডারমা ভিরিডি জীবাণু ২০০ গ্রাম ১০ লিটার জলে গুলে ধানের চারা ১০ মিনিট দেরি নিয়ে রােপণ করতে হয়।
মল জমিতে রােগ হলে ;
৮০ গ্রাম ট্রাইকোডারমা ভিরিডি ১২০ লিটার জলে গুলে বিকেলের দিকে স্প্রে করতে হয় ।
FAQপ্রায়ই জিজ্ঞাসিত প্রশ্নাবলী -
১। ধানের পোকামাকড় ও ব্যাকটেরিয়াল রোগ নিয়ন্ত্রণ জৈব পদ্ধতিতে কি সম্ভব ?
২। গোমূত্রের ব্যবহারের উপকারিতা কি ?
৩। আলু ,টমেটো ,বেগুন ইত্যাদির পাতার ধ্বসা রোগ কিভাবে নিয়ন্ত্রণ করা যায় ?
৪। কলার গায়ে বিটল আক্রমণের দাগ নিরাময়ের উপায় কি ?
তথ্য সূত্র
1. Controlling Crop Pest & Disease by Rosalyn Rapaport, Pub. Macrillian
2. Neem National Res. Control, USA, Pub in National Academy press WashingtonD.C, 1992.
3. Neem- Auser's Manual, Vijaylaxmi, Radha & Shiva Pub.by Centre for Indian
4.Results of trials and experimentss, Conducted by Sustainable Agriculture Net work, West Bengal
আরও দেখুন -
- পরিবেশবান্ধব পদ্ধতিতে ধানের রোগপোকা নিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি
- গােবর গ্যাস স্লারি কি ?এবং কৃষি ক্ষেত্রে এর ব্যবহার -
- ফসফো কম্পোস্ট কি ?ফসফো কম্পোস্ট সার তৈরী সহজ পদ্ধতি এবং ব্যবহার
- সুস্থায়ী কৃষি ব্যবস্থাপনা জৈব সারের গুরুত্ব
- জৈব কীটনাশক তৈরী পদ্ধতি
- বোর্দ্য দ্রবণ তৈরী পদ্ধতি। ভাইরাস নাশক তৈরী পদ্ধতি। SPNF
- দ্রুত কম্পোস্ট সার তৈরী পদ্ধতি
- তরল জৈব সার তৈরী ও ব্যবহার পদ্ধতি -
- সবুজ সার ব্যবহার করে মাটির উর্বরতা শক্তি বাড়িয়ে তোলা যায় সহজেই
- সবুজ সার কি? সবুজ সার তৈরী পদ্ধতি -
- গোবর দিয়ে নার্সারির জন্যে পরিবেশবান্ধব টব বা পট তৈরীর সহজ পদ্ধতি-
- জৈব কীটনাশক অগ্নিঅস্ত্র কি ? কিভাবে তৈরি করবেন ? কিভাবে ব্যাবহার করবেন ? চাষের জন্যে কতটা লাভদয়ক ?
- জীবান্মৃত কিভাবে তৈরি করব ? জৈব চাষে জীবান্মৃত কিভাবে কাজ করে ? এবং এর ব্যাবহার কিভাবে হয় ?
- অমৃত জল বা মিরাক্কেল জৈব তরল সার তৈরী পদ্ধতি
- নিমাস্ত্র কিভাবে তৈরি করে ? ব্রম্মাস্ত্র কিটনাশক কিভাবে তৈরি করে ?
- পরিবেশবান্ধব পদ্ধতিতে ধানের রোগপোকা নিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি